বাবার মেয়ে



বড় হয়ে কী হব সে নিয়ে ছোটবেলায় বিস্তর প্রশ্নের মুখোমুখি সবাইকেই হতে হয়। প্রশ্নটা আমার খুবই শক্ত লাগত। আমি কখনই জানতাম না বড় হয়ে আমি কী হব, কাজেই হাসিমুখে চুপ করে থাকতাম। আর লোকে ভাবত সোনা কী শান্ত আর লাজুক। কিন্তু তাঁরা যদি একটু বুদ্ধি খাটিয়ে কী হতে চাইয়ের বদলে কী হতে চাইনা সেটা জিজ্ঞেস করতেন, তাহলেই আমি এক মিনিটও না ভেবে, একটুও লজ্জা না পেয়ে উত্তরটা বলে দিতে পারতাম। যে আমি মরে গেলেও অফিসে কাজ করতে চাইনা। আমার কাছে অফিস মানে তখন ছিল লজঝড়ে লিফটে চেপে সাততলার ওপরে উঠে খোপখোপ চেম্বার, সারি সারি ডেস্ক, ক্যাঁচক্যাঁচে সিলিং ফ্যান, ফাইল ওগরানো লোহার গোদরেজ আলমারি। যেরকম অফিসে আমার মা বাবা চাকরি করতে যেতেন।

তবে সবার ছোটবেলা একরকম হয় না। অনেকের দেখেছি একেবারে উল্টোটা হয়। “আমাদের তো বাড়িসুদ্ধু সবাই ডাক্তার/ইঞ্জিনিয়ার”---অনেক বন্ধুকে খুব গর্বিত হেসে বলতে শুনেছি। আজকাল এর সাথে আরেকটা পেশাও যোগ হয়েছে। ফিল্মস্টারের ছেলেমেয়েরা বড় হয়ে সবাই ফিল্মস্টার হয়। আমি বাজি রেখে বলতে পারি বেবি বি-কে কেউ কখনো বড় হয়ে কী হতে চাও জিজ্ঞেস করে উত্যক্ত করবেনা।

লিখতে লিখতে একেবারে উল্টো একটা উদাহরণ মাথায় এসে গেলো। স্কুলশিক্ষক বাবামায়ের ছেলেমেয়েরা আজকাল দৌড়ে MBA পড়তে যায় শুনেছি। সেই যে ইংরিজিতে বলে না, স্কারড ফর লাইফ? সেরকমই কিছু একটা হবে নিশ্চয়।

হোয়াটেভস। যে কথা হচ্ছিল। কেউ বড় হয়ে পেশাগত ক্ষেত্রে বাবা মায়ের পদাঙ্ক অনুসরণ করতে চায়, কেউ চায়না। আমি চাইতাম না। শুধু না-চাইতামই না, দশটা-পাঁচটা অফিসের চাকরির প্রতি আমার বিবমিষা একসময় এমন তীব্র ছিল আমি অ্যানাকোন্ডা সংকুল রেন ফরেস্টেও ক্যামেরা ঘাড়ে করে যেতে রাজি ছিলাম, কিংবা ল্যাগবেগে উটের পিঠে চেপে ঠা-ঠা সাহারা মরুভূমিতে পেট্রোলিয়ামের খোঁজে ঘুরে বেড়াতে, তাতে যদি কোনমতে সপ্তাহে পাঁচদিন বি-বা-দী বাগ যাওয়াটা এড়ানো যায় স্রেফ এই আশায়। 

কী করে বাবা মায়ের থেকে একেবারে অন্যরকম কিছু হওয়া যায় সেই ভেবে ভেবে আমার দিনরাত কাটত। বাবা মা যেখানে হেঁটেচলে, বাজারদোকান করে, ডাক্তারখানা গিয়ে, পাড়াপড়শির সাথে আলাপ করে বেড়াতেন, কী করে সেখান থেকে পালিয়ে বাঁচা যায় সেই ভেবে ভেবে আমার রাতে ঘুম আসত না। 

সে অনেকদিন আগের কথা। এই ধরুন কম করেও বছর ১০-১২ তো হবেই।

গত সপ্তাহে YouTube-এ Above Suspicion-এর একটা এপিসোড দেখছিলাম। সেখানে প্রধান চরিত্র ডিটেকটিভ কনস্টেবল অ্যানা ট্র্যাভিস। টেস্টোস্টেরন টইটম্বুর ডিপার্টমেন্টে প্রত্যাশিত প্রতিকূলতা ঠেলেঠুলে উন্নতি করছেন, গোয়েন্দাগিরির স্বাভাবিক ক্ষমতা আর নীরব গোঁ সম্বল করে। একটা কেস প্রায় একা হাতে সমাধান করার পর একেবারে ওপরতলায় অ্যানার ডাক পড়ল। করমর্দন করে বয়োজ্যেষ্ঠ অফিসার জিজ্ঞাসা করলেন, “So you are Jack Travis’ girl?”

কেলি রাইলি খুব ভালো অভিনয় করেছেন, নাকি গোটাটাই আমি কল্পনা করেছি জানিনা, কিন্তু আমি স্পষ্ট দেখলাম “Yes sir” বলার সময় অ্যানার মুখে অন্যরকম একটা আলো ফুটে উঠতে। নিজের যোগ্যতা নিজে প্রমাণ করার যে আলো, সেটা নয়। মা-বাবার যোগ্য সন্তান হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করার যে অন্য আলোটা, সেটা।

মনে আছে একদিন তারকেশ্বরের লেডিস কামরায় বসে চেঁচিয়ে গল্প করতে করতে কলেজ যাচ্ছিলাম। সুজাতা কী যেন একটা খুব মজার কথা বলেছিল, হাসতে হাসতে সিট থেকে পড়েই যাচ্ছিলাম প্রায়। পেছন থেকে টিপিক্যাল মা দেখতে একজন ভদ্রমহিলা পিঠে টোকা মেরে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “অর্চনার মেয়ে?” আমি থতমত খেয়ে ঘাড় নাড়তে বললেন, “হাসি শুনেই বুঝেছি।” বলে আবার পেছন ফিরে গম্ভীর মুখে উল বুনতে লাগলেন।

ঘটনাটা মনে পড়লে এখন আপনা থেকেই ঠোঁটে হাসি চলে আসে আমার। এখন মাঝে মাঝে ভাবি যদি ডালহৌসির সাততলায় অফিস হতো আমার কেমন হতো তবে? আমার মা বাবাকে যারা চিনতেন, তাঁরা আমাকে হাত নেড়ে কাছে ডেকে বাকিদের সাথে আলাপ করাতেন, “এ কে বলুন তো? কল্যাণদার মেয়ে” বলে। কুন্তলা নামটা যেমন ভালো, ‘কল্যাণদার মেয়ে’ বা “মিসেস ব্যানারজির মেয়ে’ নামগুলোও আজকাল খুব প্রিয় লাগে নিজের মাথার ভেতর, কেউ ঐ নাম ধরে আর ডাকে না বলেই বোধহয়। 

Comments

  1. Ekta golpo mone pore gelo ei shutre - Ekjon bhadroloke "Dabur" e kaj koren. Tar office e promotion holo, shey khushi hoye tar boss ke nemontonno korlo ekdin bari te khete. Boss to elen, bhadrolok ar tar wife to besh khete tete diyeche. Boss er naam dhoro Mr. Chatterjee. To sei Chatterjee ei bhadrolok er chhoto chhele ke moja kore jigyesh korechen. "Ki babu, tumi boro hoye ki hobe?" 4 yrs er chheler tokkhuni uttor, "Ar jayi hoyi, baba'r moto Dabur e kaj korbo na. Tarpor Mr. Chatterjee'r moto ekta boss holei to gechi!!"

    ReplyDelete
    Replies
    1. হাহা সায়রী, এরকম কটরকটর করে কথা বলা বাচ্চা ভীষণ মজার। মানে অন্যের বাচ্চা আরকি, আমারটা সাত চড়ে রা কাড়বেনা।

      Delete
  2. মিষ্টি লেখা... শেষটা আরো ভাল লাগলো unorthodox build up টার জন্য... :) এবার তো আমাদের জন্যেও লেখা চাই ম্যাডাম... kotha2bolarjonyei@gmail.com
    অপেক্ষায় থাকলাম...

    ReplyDelete
    Replies
    1. সুনন্দ, ভাল লেগেছে জেনে খুশি। নিশ্চয় নিশ্চয়, 'কথা'য় লিখতে পারলে আমারই খুব ভাল লাগবে। কিন্তু একটু ভেবেচিন্তে সাজিয়ে গুছিয়ে লিখতে হবে তো... দাঁড়ান একটু মাথা খাটাই।

      Delete
  3. ishh! keno je amader desher politician er chele piley gulo tomar moto emonti bhabe na :(

    ReplyDelete
    Replies
    1. দেখেছ শম্পা, সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণটার কথাই বলতে ভুলে গেছিলাম। রাজনীতিক! তুমি মনে করিয়ে দিলে, থ্যাঙ্ক ইউ।

      Delete
  4. ওই ট্রেনের যে গল্পটা বললেন, ঐরকমটা আমার সঙ্গেও ঘটেছে| তবে আমায় হাসতে হয়নি, দুর্গা ঠাকুর দেখার সময়ে আমায় দেখেই এক ভদ্রমহিলা বুঝতে পেরেছিলেন আমার বাবা কে, এবং তিনি আমায় আগে কোনদিন দেখেননি | আমার অবশ্য বাবার অফিস বেশ ভাল লাগত, আর বাবার মতন কাজ করতেও ইচ্ছে করত| তখন কি আর জানতাম, যে আমার লাইন একদিন সম্পূর্ণ আলাদা হয়ে যাবে? দাদুর সঙ্গে হয়ত খানিকটা মিলবে, কিন্তু বাবার সঙ্গে না|

    ReplyDelete
    Replies
    1. হাহা সুগত, আমি অবশ্য আপনার বাবাকে দেখিনি কোনদিন তাই কতোটা মিল বলতে পারলাম না। আহা মেলেনি কোথায়, ইঞ্জিনিয়ার অংশটুকু মিলেছে তো।

      Delete

Post a Comment