মায়েদের জন্য


দীপমালা আমাদের ক্লাসের বি সেকশনে পড়তো। আমার সাথে ওর বিশেষ জানাচেনা ছিলোনা কখনোই। আমরা এ সেকশনে পড়তাম কিনা, তাই বি সেকশনের মেয়েদের বিশেষ পাত্তা দিতাম না। তবে ভালো আবৃত্তি করতো আর ছবি আঁকতো দীপমালা, সেটা না মেনে উপায় ছিলোনা।

তবে দীপমালার আসল খ্যাতির জায়গাটা আঁকাও ছিলোনা, আবৃত্তিও না। ছিলেন দীপমালার মা। ছেলেমেয়ে নিয়ে বাড়াবাড়ি কমবেশি সব মায়েরই থাকে, কিন্ত দীপমালার মা সবাইকে ছাড়িয়ে গেছিলেন। আমাদের একতলার ক্লাসরুমে হাফ ইয়ারলির অঙ্ক পরীক্ষা হচ্ছে, আর দীপমালার মা জানালার পাশ থেকে ক্রমাগত উঁকিঝুঁকি মেরে দেখছেন মেয়ে ঠিকঠিক লিখছে কিনা, এ দৃশ্য স্পষ্ট চোখে ভাসছে। রাঙাদিদিভাই গার্ড দিচ্ছিলেন। বার পাঁচেক ভদ্রমহিলাকে চলে যেতে বলার পরও যখন তিনি শুনলেন না, তখন দিদিভাই গলা যথাসম্ভব কঠিন করে বলেছিলেন, আপনি এক্ষুনি স্কুল থেকে না বেরিয়ে গেলে আপনার মেয়েকে হল থেকে বার করে দেওয়া হবে। তাতে কাজ দিয়েছিলো মনে আছে।

কিন্তু তার থেকেও বেশি মনে আছে ক্লাস ফোরে পড়া দীপমালার মুখটা।

বাড়ি এসে খুব হিহি করে হেসে গল্পটা বলায় মা গম্ভীর হয়ে বলেছিলেন, গুরুজনকে নিয়ে ঠাট্টা করতে নেই সোনা। মায়ের মনে সন্তানের জন্য কখন কী দুশ্চিন্তা হয়, সেটা কী কেউ বলতে পারে?

অর্থাৎ কিনা মায়েদের সাত খুন মাপ। সে তাঁরা বাড়িতে অতিথি এলে “সোনা যাও তো কবিতার খাতাটা নিয়ে এসো তো” (আমার মা এটা কখনো করেননি যদিও, করলে আমি মাকে ত্যাজ্য করতাম) বলুন, কিংবা ছেলে “টেকনিক্যাল লাইনে” না গিয়ে ভূগোলে অনার্স নিলে দুঃখে লোকলজ্জায় শয্যা নিন, কিছু বলা যাবেনা।

আমার ঠাকুমা এটাকেই একটু সাজিয়েগুছিয়ে বলেন, “কুপুত্র যদি বা হয়, কুমাতা কখনো নয়।”

আমি নিজে সে কথা মানিনা অবশ্য। এই ৩১ বছরের জীবনে আর কিছু না দেখি, কিছু অদ্ভুত মা দেখেছি। ছেলেরা কিছু মাইন্ড করবেন না, কিন্তু দেখেশুনে আমি এই সিদ্ধান্তে এসেছি যে মেয়ের মায়েদের থেকে ছেলের মায়েরা বেশি অদ্ভুত হন। একবার কলেজ থেকে বাড়ি ফিরছিলাম আর আমার পাশে দুজন মোটামতো মহিলা বসে আলাপ করতে করতে যাচ্ছিলেন। আমার সাথে সেদিন আর কেউ ছিলনা, কাজেই আমি বসে বসে খামোকা বোরড না হয়ে তাঁদের কথায় আড়ি পাতছিলাম। পেতে যা বুঝলাম, দুজনে প্রতিবেশি, দুজনেরই একটি করে পুত্র, দুজনেরই পুত্রের বিয়ের বয়স হয়েছে, পার্থক্য শুধু এই যে একজনের ছেলের সদ্য বিয়ে হয়েছে, আরেকজনের ছেলের জন্য তখনও মেয়ে দেখা চলছে।

নতুন শাশুড়িকে তাঁর প্রতিবেশি জিজ্ঞেস করলেন, “কী দিদি, নতুন বউ কেমন লাগছে?” শাশুড়ি মুখব্যাদান করে বললেন, “নতুন নতুন তো সবাই ভালো থাকে দিদি, ক’দিন যাক, তারপর বোঝা যাবে কে কেমন।” প্রতিবেশি বললেন, “যাই বলুন বউয়ের মুখটা কিন্তু মিষ্টি।” শাশুড়ি বললেন, “সে মিষ্টি, কিন্তু রঙটা একটু বেশি চাপা না?” প্রতিবেশি বললেন, “আহা আপনার ছেলের পছন্দ হয়েছে তো, তাহলেই হবে।” শাশুড়ি অসম্ভব করুণ মুখ করে ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, “হলেই ভালো। আমার আর কী, আমি তো মরেই যাবো আর ক’দিন পর।”

ততক্ষণে রিষড়া এসে গিয়েছিলো, তাই বাকিটুকু শোনা হয়নি। তবে যা শুনেছি তাতেই আমার মনে শাশুড়ির ভয় ধরে গেছে। বাপরে।

পরের মায়ের নিন্দে করলাম যখন নিজের মায়ের নিন্দেটাও এই বেলা করে রাখি। আমার মা এমনিতে লোক ভালো, কিন্তু আপনি যদি আমার বন্ধু হন, আর আপনার ফোন নম্বর যদি কোনক্রমে আমার মায়ের হাতে গিয়ে পড়ে, তাহলে ভগবান আপনাকে রক্ষা করুন। আমার ফোনে দু’বার নো রিপ্লাই পেলেই মা ধরে নেন যে আমি নির্ঘাত ঘরের ভেতর মরে পড়ে আছি, কিংবা নিদেনপক্ষে আমাকে কেউ কিডন্যাপ করে নিয়ে গেছে। তখন তিনি পাগলের মতো আমার সমস্ত বন্ধুকে ফোন করতে থাকেন। সুদীপ্তকে যে কতবার ঘোর তুষারপাতের ভেতর হেঁটে হেঁটে ক্যাম্পাস পেরিয়ে আমার হোস্টেলে গিয়ে কড়া নাড়তে হয়েছে, তার গোনাগুনতি নেই। তারপরেও যে ও আমার সাথে হেসে কথা বলে, সে জন্য আমি সুদীপ্তর কাছে চিরকৃতজ্ঞ।

আমি নিন্দে করলাম বলে আপনারা যেন আমার সামনে আমার মাকে নিয়ে ভুলেও ভালোমন্দ কিছু বলবেন না। তাহলে আমি আর কোনদিন আপনাদের সাথে হেসে কথা বলবোনা। আমার মা যতই খারাপ হোন না কেন, তিনি আমার মা। আমার জন্য সারা পৃথিবীতে তাঁর থেকে ভালো মা আর কেউ হতে পারতোনা, পারবেও না কোনদিন।

আমি নিশ্চিত দীপমালাও কাকিমা সম্পর্কে ঠিক এমনি করেই ভাবে।

পৃথিবীর সমস্ত মায়েদের----ভালো বাজে, ফরসা কালো, রোগা মোটা, লম্বা বেঁটে, সবরকম মায়েদের---আমার তরফ থেকে হ্যাপি মাদার’স ডে’র অনেক অনেক শুভেচ্ছা রইলো। আপনারা আমাদের আরও বেশি বেশি ভালোবাসুন, আরও বেশি বেশি লাই দিয়ে মাথায় তুলুন, মনেপ্রাণে এই কামনা করি।



*****

আপনারা কী ভাবে মাতৃদিবস পালন করবেন ভেবে রেখেছেন?

আমি ভেবে রেখেছি কাল সকালে মা’কে ব্রেকফাস্ট বানিয়ে খাওয়াবো। ফ্যান্সি কিছু নয়, ওই রোজকার কর্ণফ্লেক্স দুধের বদলে আরেকটু ঘোরালো কিছু।  তাছাড়া বান্টির কম্পিউটার থেকে “চিলড্রেন অফ হেভেন” কপি করে এনেছি, মা মেয়ে  মিলে বসে দেখার ইচ্ছে আছে। আমি শিওর দেখে মা এক গঙ্গা কাঁদবেন। আর চেষ্টা করবো, কালকের দিনটা অন্তত মায়ের সব কথা শুনে চলতে, মায়ের কথার উত্তরে একবারও ঝাঁঝিয়ে না উঠতে। যদিও জানি উঠলেও মা আমাকে একচুল কম ভালোবাসবেন না।

Comments

  1. Ei comment ta ami sudhu chhobi ta dekhe dichhi. Pore lekhata pore comment debo. Eta ami din koyek agey thekei bhabchi facebook e debo Mothers' day te :) Arekbar proved holo je "great minds think alike" :D

    ReplyDelete
    Replies
    1. হাহা রিয়া, ট্রু, ট্রু।

      Delete
  2. Amar ek bondhu'r ma take phone e na pele Dhaka theke amay Birmingham e phone korten. Ebong segulo onek somoyei hoto raat 12ta, bhor 4te, erokom time e ar bolten "Mamoni, amar meye thik thak ache to?" Bola bahulyo, meyeti kintu amar theke boyeshe boro ebong bibahita :) Tobe oi "ma der to chinta hotei pare" bhebe ar especially "mamoni" bole dakten ar onek "Allah tomay bhalo rakhun" bolten bole amar sotyi kintu kichu kharap lagto na :)
    Ei chhobi ta facebook e diye ma ke tag korechi. Ma boleche "jyanto chhana" ta DEFINITELY ami tobe ma'r nijer Panto bhut hote ektu apotti ache. Tobu boleche "I appreciate the concept behind it".
    Amio dekhechi go, chhele der ma era comparatively ektu beshi "amar chhele, amar chhele" kore, meye'r mayera onek normal bondhu'r moto behave kore meyera boro hoye gele. (No offense meant to any chhele'r ma, jodio).

    ReplyDelete
    Replies
    1. দেখেছ, আমার মা দাবি করেন আমার বিয়ে হয়ে গেলেই নাকি উনি সমস্ত চিন্তা মুক্ত হয়ে হাওয়া খেয়ে বেড়াবেন। তখন আরও বেশি চিন্তা হবে, কী জানি মেয়েটা খেটে খেটে মরল কিনা, কী জানি জামাই ধরে ঠ্যাঙালো কিনা...

      হাহা, কাকিমার আপত্তিটা আমি বুঝতে পারছি। তবে 'জ্যান্ত ছানা'র তকমা পাওয়ার জন্য তোমার প্রতি আমার অভিনন্দন রইল।

      Delete

Post a Comment