পঞ্চমী ষষ্ঠী আপডেট



আমার বহুদিনের একটা নালিশের সুরাহা হয়েছে। সেই ছোটবেলা থেকে দেখছি বোরিং বড়রা (আর কিছু কিছু এঁচোড়ে পাকা ছোটরাও) বলে আসছেন, পুজো চারদিনের, পুজো চারদিনের। মহাষষ্ঠীকে এই যে গলাধাক্কা দিয়ে উৎসব থেকে বার করে দেওয়ার চক্রান্ত, এটা আমার অসহ্য লাগে। চারদিন বললেই হল? আমার যে তিন মামা, চার মাসি, এক জেঠু, দুই কাকু মিলিয়ে গোটা দশেক জামা হয়েছে সেগুলো এক-একবেলায় এক-একটা করে পরতে গেলেও তো মিনিমাম পাঁচটা দিন আমার লাগবে, না কি? আর সপ্তমী থেকে পুজো শুরু হলে ষষ্ঠীর দিনটাতেও যে চক্ষুলজ্জার খাতিরে হলে বই খুলে বসতে হবে, সেটা কি কারো খেয়াল আছে?

এখন শুনছি কলকাতায় ষষ্ঠী তো দূরের কথা, দ্বিতীয়া থেকে পুজো শুরু হয়ে যাচ্ছে। মুখ্যমন্ত্রী বলে দিয়েছেন, মাদুর্গার আছে বলেই তো তাঁরও দশটা হাত নেই, কাজেই তাঁকে দিয়ে রাজ্যশুদ্ধু প্যান্ডেলের ফিতে কাটাতে হলে কাউকে কাউকে দ্বিতীয়াতেই কাটাতে হবে। অতএব দ্বিতীয়াই সই। শুনে আমার প্রাচীনপন্থী বন্ধুরা মুখ ভেচকে বললেন, “যত্তসব বাড়াবাড়ি, আমাদের আমলে তো...”

আমি বলি, ঠিকই আছে। ওই পেটমোটা গণেশকে নিয়ে মারাঠিরা যদি এগারোদিন নাচাগানা করতে পারে তাহলে মাদুর্গার হোল ফ্যামিলি, হোল ফ্যামিলির বাহনবৃন্দ, প্লাস ওই ষণ্ডা মহিষাসুরের জন্য পাঁচদিন নেহাতই কম। বলি আর এ আমলের লোকদের প্রতি হিংসেয় বুকটা অল্প অল্প ফাটতে থাকে। আমার তো এখন দশটা নয় পাঁচটা নয়, সাকুল্যে একখানা নতুন জামাও হয় না, আর পুজোর মাঝখানে একগাদা ডেডলাইন পড়ে। আমার যখন হাতে অঢেল সময় ছিল আর নতুন জামার অভাব ছিল না, তখন যে কেন কারো দশদিনের পুজোর আইডিয়াটা মাথায় আসেনি, ভেবে আমি ছোট্ট ছোট্ট দীর্ঘনিঃশ্বাস ছাড়ি।

বাকিদের কাছে যখন প্যান্ডেল হপিং আর জাঙ্কফুড ইটিং-এর জন্য দশদিন রয়েছে, তখন আমার কাছে ছিল মোটে দুদিন, শনি আর রবি।

কিন্তু সীমিত রিসোর্সকে এফিশিয়েন্টলি অ্যালোকেট করার চ্যালেঞ্জ দেওয়ার পক্ষে সবথেকে খারাপ পছন্দ যদি কেউ হয়ে থাকে, তাহলে সেটা গত চোদ্দ বছর ধরে ইকনমিক্স বইয়ের পাতা উলটোনো কেউ।

প্রথমেই আমি একটা মাস্টারপ্ল্যান ছকে ফেললাম। আগের উইকএন্ডে চায়ের কাপ হাতে নিয়ে বসে জানালার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে মস্তিষ্কের এক্সেলশিটে লিখে ফেললাম, পুজোর দুদিনে কী কী করতেই হবে। লিখে ফেললে যেমন জটিল থেকে জটিলতর সমস্যাও সরল হয়ে যায়, তেমনি আমার মাস্ট ডু লিস্ট দেখেও আমি না হেসে পারলাম না।

ব্যস? এই? দাঁড়ান আপনাদের দেখাচ্ছি লিস্টটা।

  • রিল্যাক্স করা
  • খাওয়া
  • ঠাকুর দেখা
  • নতুন জামা পরা
সপ্তাহের কাজের ফাঁকে ফাঁকে পুজোর প্রস্তুতি চলল, সুটকেস ঘেঁটে ন্যাপথালিনের পাহাড়ের তলা থেকে শাড়ি এবং অন্যান্য ম্যাচিং জিনিসপত্র টেনে বার করা হল, ড্রয়ার হাঁটকে মানানসই চুলের ক্লিপ আর কানের দুল আর হাতের চুড়ি বেছে রাখা হল, একদিন বিকেলে আগেভাগে অফিস কেটে খানদুয়েক অফিসে যাওয়ার জামা কিনে নাম-কা-ওয়াস্তে পুজো শপিং-ও করে আনা হল। সত্যি বলতে কি, মাদুর্গার নাম করে খানিক পয়সা খরচ করতে হয় বলে করা। পুজোয় পরব তো সেই বাড়ি থেকে নিয়ে আসা ট্রেডার্স অ্যাসেম্বলির বটল গ্রিন বমকাই।

সুখের খবর, গত দুদিনে আমি লিস্টের প্রতিটি পয়েন্ট কভার করেছি। টিভির সুইচ অন করে, মাথার সুইচ অফ করে সেটার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থেকেছি। পশ্চিমবঙ্গের হাজার হাজার প্যান্ডেল থেকে বাংলা খবরের চ্যানেলের অত্যুৎসাহী প্রতিনিধিদের, অতি উচ্চগ্রামে বাঁধা কণ্ঠস্বরের প্রতিবেদন শুনেছি, জট পাকানো চুল আর ব্রণ ভরা গাল নিয়ে শুয়ে শুয়ে কেয়া শেঠের পুজোর মেকআপের প্রতিটি টিপস মনোযোগ দিয়ে নিয়েছি, চানাচুরের প্যাকেট সাবাড় করতে করতে দুই বৌদির মধ্যে ডাবচিংড়ি রান্নার কমপিটিশন দেখেছি। রবিবার সকালে লুচি আলুরদমের অ্যাডভেঞ্চারেও নেমেছিলাম। আলুরদমটা মন্দ হয়নি, লুচিগুলো কেবল শ্রীলঙ্কার ম্যাপের মত দেখতে হয়েছিল। কিন্তু প্রত্যেকটা ফুটবলের মত ফুলেছিল, কাজেই আমি একটুও লজ্জা পাচ্ছিনা। ইন ফ্যাক্ট, আপনাদের কারো লুচি রান্নার টিপস দরকার হলে আমাকে ই-মেল করতে পারেন। হাতে ধরে বুঝিয়ে দেব। মনে রাখবেন, ক্রুশিয়াল পয়েন্ট হল কড়াইয়ের তেলের টেম্পারেচারটা। বাকি সব বাঁয় হাত কা খেল।

লিস্টের কী বাকি রইল তবে? নতুন জামা পরে ঠাকুর দেখা। দু’দিনই বেরিয়েছিলাম। ধড়াচূড়া পরে। কত লোক দেখলাম বাসরে। আর কতরকম সাজ। মাথায় সাইকোডেলিক হাইলাইট, জুলপির কারুকাজ, কবিতা-লেখা গোড়ালি-ছোঁয়া পাঞ্জাবি, অনভ্যাসের ছ’ইঞ্চি হিল পরে খুটখুটিয়ে হাঁটার জিমন্যাস্টিক দেখতে দেখতেই ঘাড় ব্যথা হয়ে গেল, ঠাকুর আর দেখব কি।

তবে পুজো প্যান্ডেলের সবথেকে আকর্ষণীয় দৃশ্য দেখতে গেলে ঘাড় ঘোরাতে হয় না, নিচু করতে হয়। আমার হাঁটুর হাইটের ছুটন্ত কুচিকুচি বিচ্ছু বাচ্চা দেখে দেখে আমি সত্যি বলছি একটা কেন, দেদার সন্ধ্যে কাটিয়ে দিতে পারি। ওস্তাদ বাচ্চা, ভেবলু বাচ্চা, বেলুন ফেটে যাওয়া দুঃখী বাচ্চা, ভীষণ রাগী গোমড়া বাচ্চা। বড়রা যখন আই কন্ট্যাক্ট এড়ানোর বিদ্যাটা অতিকষ্টে রপ্ত করে ফেলেছে, তখন তাদেরই সন্তানসন্ততিরা বাবার কাঁধে চিবুক রেখে সটাং তাকিয়ে আছে আপনার দিকে। স্টেয়ারিং গেমে তাদের হারায় সাধ্য কার। সেরকম একজনের দিকে তাকিয়ে আমি নানারকম মুখভঙ্গি করে তার মনোযোগ টেনে রাখার চেষ্টা করছিলাম, হতভাগা আমাকে মুখ ভেংচে ঘাড় ঘুরিয়ে নিল।

ব্যস, হয়ে গেল আমার পুজো। আপনাদের অনেকের পুজো এখনও চলছে জানি, চলুক চলুক, আমি একটুও হিংসে করব না। শুধু মাঝে মাঝে ঘাড় গুঁজে টাইপ করার ফাঁকে ফাঁকে এ বি সি ডি, এন্টার, স্পেসবার ঝাপসা হয়ে গিয়ে চোখের সামনে অন্য কয়েকটা দৃশ্য ভেসে উঠবে। উঁহু, এই দুদিন যা দেখলাম সেগুলো নয়। হাজার হাজার মাইল দূরের, কে জানে কবেকার একটা পুজো, টাইমমেশিনে চেপে, চেনামুখের ভিড়, ধুনোর গন্ধ আর ঢাকের বাদ্যি নিয়ে সোজা আমার বুকের মধ্যে এসে কড়া নাড়বে। এসে আমার মুখটা অজান্তে হাসিহাসি করে দিয়ে যাবে। ওটা কে? আরে চিনতে পারছেন না? ওটাই তো আমার পুজো।

আপনাদের সবার জন্য শারদীয়ার অনেক প্রীতি, শুভেচ্ছা আর ভালোবাসা রইল। পুজোর ক’টাদিন খুব আনন্দ করুন এই কামনা করি।

Comments

  1. Tomakeo jaani sharadiya shubechha. gatobochar deshe pujo katiyechilam tai shei tulonay ebochar ta ektu phike hoye gelo :(

    ReplyDelete
    Replies
    1. আহারে শম্পা, দুঃখ পেও না। পরের বছর আবার বাড়ি যেও'খন।

      Delete
  2. hmmmm...amaro choto choto drighoswash porche...amio sashthir din rate akta natun jama pore ekhane akta thakur dekhe esechi,ar seshe..dimer devil,chicken tikka,ar mishti doi kheye elam...byas..ar ki...!ei pujoy mone hocche etukui..:(

    ReplyDelete
    Replies
    1. আরে এটুকু কেন তিন্নি? আরও তিন দিন তো আছে, বলছি রাণী মুখার্জির পুজোটা দেখে আয়।

      Delete
  3. ছোট্ট ছোট্ট দীর্ঘনিঃশ্বাস? কথা তৈরির খেলায় ওই দাড়িওলা বুড়োকেও হারিয়ে দেবেন দেখছি!

    আমিও আপনাদেরই মতন একটা বাড়িতে বড় হয়েছিলাম, একটা মাঠে ক্রিকেট খেলেছিলাম, একটা স্কুলে পড়তে যেতাম, একটা রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে সিগারেট খেতে শিখেছিলাম... এখন যেখানে থাকি, এই জায়গাটা সেই আগের জায়গা থেকে অনেএএএএএএক দূরে। গত দশটা পুজোর মধ্যে শুধু একবার আমি সেই আগের পাড়ায় ছিলাম।

    কেমন জায়গা সেটা? অব্যাবস্থার চুড়ান্ত, মাইকে হরদম তারস্বরে চামেলি আর মুন্নি আর শিলার জীবনকাহিনী, রাস্তাঘাটে ট্রাফিক জ্যাম, বাচ্চা হারানোর ঘোষণা, কুড়ি টাকা প্লেটের ঝালমুড়ি। তবু ওটা আমার।

    আর বাকি নটা পুজো? বেশ ছিমছাম, সুবিধেজনক পুজো, বড় বড় ব্যাপার, বড়লোকের বউদের মত। এখানে সবাই ওই কুড়ি টাকা প্লেটের ঝালমুড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছেন, এসে নতুন জায়গায় নতুন পুজো কমিটি গড়েছেন, ওখানেও কোঁদল করছেন, একটা পুজো থেকে দুটো পুজো হতে খুব বেশি সময় লাগছে না।

    যখন মোটামুটি বোঝা গেল যে পাকিস্তান হবেই, সেরকম একটা দিনে আমার বাবা তাঁর বাবার হাত ধরে একটা অচেনা জায়গার একটা অচেনা বাড়িতে এসে উঠেছিলেন। সেই অচেনা জায়গাতে যখন দুর্গাপুজো হল, তখন আমার বাবার তাঁর আগের গ্রামের পুজোর কথা ভেবে ছোট্ট ছোট্ট দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলেছিলেন নিশ্চয়, আমি সেটা দেখিনি। যা দেখেছি, তা হল তিরিশ বছর বাদে প্রতিবার পুজোয় বাবা পাড়ার আর সব কাকুজেঠুদের সাথে মিলে কমিটি করতেন, কোঁদল করতেন, আর সবচেয়ে বড় কথা, পুজো করতেন। তখন আর গ্রামের পুজোর কথা ভেবে মন খারাপ হত না বাবার। গ্রামের পুজোর কথা মনে পড়ত কিনা, তাই বা কে জানে!

    আমি বুড়ো হয়ে যাচ্ছি, তাই অচেনা পাড়ার পুজোটাই আস্তে আস্তে আমার পুজো হয়ে যাচ্ছে।

    সবাই ভালো থাকবেন। আজ মহাষ্টমী, আমি অফিসে, আপনারাও অনেকেই অফিসে নিশ্চয়। চালিয়ে যান, চালিয়ে যাবার নামই চরৈবেতি। চরৈবেতি।

    ReplyDelete
    Replies
    1. অসাধারণ কমেন্ট দেবাশিস। খুব খুব ভালো লাগল পড়ে। ওদেশ থেকে আসা বাবাঠাকুরদা'র গল্প এখনো মনে কীরকম দাগ কাটে না? হয়ত সবার কাটে না, তাঁদের নাতিনাতনিদেরই কাটে।

      এরকম মন্তব্য পাওয়ার জন্যই তো অবান্তর চালিয়ে যেতে ইচ্ছে করে। আপনাকে অনেক শারদীয়া শুভেচ্ছা জানালাম। আর সার্থককেও।

      Delete
    2. Khub mon kamon kore uthlo kuntala dir post ar ei comment ta pore...amio aj tin bochor holo akta "ochena" pujo katiye aschi..khub bhoy kore, ei "ochena" pujo ta jeno kokkhono o amar chena na hoye othe..

      Delete
    3. debasish babu'r odesh ba opar er goppo ta porte khub bhalo laglo. amader bari'r opar er pujo epar e eshe aajkal besh romrome hoye utechey. prothom 30-40 bochar choto kore hoto, mane just ghot er pujo....kintu ekhon besh matha tulechey (ek chala'r choto thakur abossho). aamra sabai je jekhane achhi contribute kori. shei purba bonger purono ebong strict puja ekhon etoi contemporary aar international hoye gechey je ebochar biliti bou thakur boron korbe shunlam :))

      Delete
    4. স্বাগতা, হয়ত চেনা হয়ে উঠলে এই পুজোটাও তোমার ভালোই লাগবে, কে বলতে পারে?

      শম্পা, আরে তোমাদের বাড়িতে পুজো হয়? দারুণ ব্যাপার তো! একদিন যাব দেখতে।

      Delete
  4. Shubho Ashtami Kuntala. tomar moton amar temon kono "amar pujo" nei, onek jaigay boro hoyechi, sei rokom bhabe kono Pujokei nijer mone hoy na. Tobe hyaan oi dosh din er jonyo suitcase holdall niye train e chore thakumar bari jaoa, notun jama pora ar sara diner hoi hoi ta miss kori. Shob cheye miss kori ajkal ar Pujor opekkhay thaki na.

    ReplyDelete
    Replies
    1. আপনাকেও শুভ পুজো বং মম। পুজোর অপেক্ষাটা চলে যাওয়া একটা মিস করার মতোই ব্যাপার বটে। তবে এগুলো বোধহয় বড় হওয়ার এক্সট্যারনালিটিস। কী আর করা, মেনে নিতেই হবে।

      Delete
  5. Amar kintu ebar Ma Durga'r kripay pujoy besh koyekta notun jama, emon ki saree hoyeche, abar ekta notun juto-o hoyeche :) Taropor online Pujo Parikrama dekha ar bari te shukto, tok daal, ilish, pathar mangsho, kheer sob shatiye khaoa :D

    ReplyDelete
    Replies
    1. আরে দারুণ পুজো কাটছে তো তোমার রিয়া। হিংসে হিংসে।

      Delete
  6. ishh! eta porey khide peye gelo :))

    btw gatobochar ma durga'r etoi kripa chilo...mane ilish er atibrishti'r thelay sheshta ilish dekhle kemon naak ta benke jachilo aarki....tai ebochar puropuri anabrishti cholce :((

    ReplyDelete
    Replies
    1. নেক্সট বছর আবার হবে, ঘাবড়াও মাত শম্পা।

      Delete
    2. Hmmm.. amar pishimoni'r shashuri ekta typical bhabe bolten (shunechi) - "atirikto kichhui bhalo noy". Ilisher khetre seta khubi applicable. Bhalo jinish aparjapto bhabe peye tar charm chole jaoyar moto koshto ar kichute nei.

      Delete
    3. ঠিকই বলেছ রিয়া, একমাত্র ফুচকা আর এগরোল ছাড়া যেকোনো কিছুই বেশি খেলে মজা চলে যায়।

      Delete

Post a Comment