৩৫ বছরের জন্মদিনে আমি যা যা করলাম




ডিসেম্বর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে কাশ্মীরে বরফ পড়ায় আমাদের দিল্লির আকাশও বেশ ক'দিন মেঘলা ছিল। শুক্রবার লাঞ্চে বেরিয়েও দেখেছি চারদিক কেমন স্যাঁতসেঁতে, ভেজা ভেজা। এদিকে আমার পঁয়ত্রিশ বছরের জন্মদিন পড়েছে সোমবার। যা উদযাপন করার শনিরবিতেই করতে হবে। তাই বেশ টেনশনে ছিলাম। কিন্তু ভালো লোকদের সবসময় ভালোই হয়। তাই রবিবার সকালবেলা হতে না হতেই ঝলমলে রোদ্দুরে আমাদের বারান্দা ভেসে গেল। আমি সেই সুযোগে আমার গাছগুলোকে একটু রোদে শুকোতে দিলাম। তারপর অটো ডেকে বেরিয়ে পড়লাম। যাব পুরানা কেল্লা।

রবিবার দুপুরে ওই তল্লাটে হইহই করছে ভিড়। সুখের বিষয় সে ভিড়ের অধিকাংশই এসেছে চিড়িয়াখানায়। আমরা টিকিট কেটে কেল্লায় ঢুকলাম। ঢুকেই ডানদিকে আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার ছোট্ট মিউজিয়াম। কেল্লার মাটি খুঁড়ে পাওয়া প্রচুর ভাঙাচোরা শিল্পসামগ্রী, যন্ত্রপাতি, গয়না, মূর্তি সাজানো আছে। পুরানা কেল্লার মাটির তলা থেকে পাওয়া এসব জিনিসপত্রের সবথেকে পুরোনোগুলোর বয়স যিশুর জন্মের প্রায় একহাজার বছর আগে। তারপর মৌর্য, শুঙ্গ, শক-কুষাণ, গুপ্ত, গুপ্ত-পরবর্তী যুগ, রাজপুত, দিল্লি সুলতানাত এবং শেষে মুঘল যুগের জিনিসপত্র রাখা আছে মিউজিয়ামে। সে সব দেখে আর দেওয়ালে টাঙানো লেখাপত্র পড়ে একটা জিনিস বোঝা গেল। এখন যে জায়গাটাকে 'পুরোনো দিল্লি' বলা হয় বয়সের দিক থেকে দেখতে গেলে সে জায়গাটা দিল্লির সবথেকে নতুন অংশ। সে জায়গার রমরমা শুরু হয়েছে শাহজাহান আসার পর। ষোলশো আটত্রিশে। তার আগে দিল্লির বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন শহর আগে থেকেই ছিল।

কেউ কেউ বলে সে সব শহরের মধ্যে সবথেকে পুরোনো হল পাণ্ডবদের শহর ইন্দ্রপ্রস্থ। ইন ফ্যাক্ট দাবি করা হয় যে এখন যেখানে পুরানা কেল্লা, সেখানেই ছিল ইন্দ্রপ্রস্থ। তার সপক্ষে খুব যে প্রমাণ পাওয়া গেছে তা নয়, তবে উনিশশো তেরো সালেও যে কেল্লার দরজার ভেতরে ইন্দরপত নামের একটা গ্রাম ছিল সে নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। যদি ইন্দ্রপ্রস্থের অস্তিত্ব স্বীকার করি তবে দিল্লির ইতিহাস পাঁচহাজার বছর পিছিয়ে যায়। আর যদি তা না করি তবে দিল্লির শহরের ইতিহাস শুরু হয় নবমদশম শতাব্দী থেকে। যখন সুরজকুণ্ডে তোমর রাজারা এসে ঘাঁটি গাড়লেন। মুসলিম আক্রমণকারীদের মোকাবিলা করার জন্য এগারোশো আশি নাগাদ পৃথ্বীরাজ চৌহান এসে কেল্লা বানালেন এখনকার মেহরৌলিতে, মোংগলদের মারার জন্য তেরোশো তিন সালে আলাউদ্দিন খলজি বানালেন সিরি ফোর্ট। সবথেকে মজা লাগল এই ভেবে, এখন যে জায়গাগুলোতে আমরা অটো চেপে হুশ করে চলে যাই, সেগুলো আগে একেকটা আলাদা আলাদা শহর ছিল। তেরোশো কুড়ি নাগাদ তুঘলকাবাদে কেল্লা বানিয়ে বসতি স্থাপন করলেন ঘিয়াসুদ্দিন তুঘলক, এঁরই ছেলে মহম্মদ পরে পাগল এবং প্রতিভাবান হিসেবে তুঘলক বংশের নাম উজ্জ্বল করবেন। বাবার বানানো কেল্লা পছন্দ না হওয়াতেই বোধহয় সিরি আর তুঘলকাবাদের মধ্যে জাহাঁপনা নামে আরেকটা শহর স্থাপন করলেন মহম্মদ বিন তুঘলক। তেরোশো পঞ্চাশ সালে ফিরোজাবাদ বানালেন ফিরোজশাহ তুঘলক, সেটা আরেকটা নতুন শহর বলে বিবেচিত হল, সেই কেল্লার ধ্বংসাবশেষই এখন ফিরোজ শাহ কোটলা বলে। এর পর বেশ কিছুদিন আবার শহর বানানো বন্ধ রইল। পনেরোশো আটত্রিশ থেকে পঁয়তাল্লিশ সাল পর্যন্ত হুমায়ুন আর শেরশাহ একই জায়গায় মারামারি করে দিনপনাহ্‌ আর শেরগড় নামের শহর বানালেন। এই জায়গাই এখন পুরানা কেল্লা বলে খ্যাত হয়েছে। সুরজকুণ্ড থেকে গুনতে শুরু করলে দিনপনাহ্‌/ শেরগড়/ পুরানা কেল্লা হল দিল্লির ষষ্ঠ শহর। এরও প্রায় একশো বছর পর, ষোলশো আটত্রিশ সালে লাল কেল্লা আর চাঁদনিচক ঘিরে শাহজাহানাবাদ বানালেন শাহজাহান। হাস্যকরভাবে যেটা পুরানি দিল্লি বলে খ্যাত হয়েছে।

যাই হোক, দিল্লির কালকাজী সন্নিহিত অঞ্চলে যে প্রস্তরযুগের মানুষদের কার্যকলাপ লক্ষ্য করা গেছে সেটা জেনে, ঘাড়ের রোম খাড়া করে আমরা মিউজিয়াম থেকে বেরিয়ে এলাম। এবার আসল কেল্লা দেখতে বাকি।

দেড় কিলোমিটার বিস্তৃত আঠেরো মিটার উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা কেল্লায় ঢোকার তিনটে গেট। এক, বড়া দরওয়াজা যেটা দিয়ে আমরা ঢুকলাম, দুই, হুমায়ুন দরওয়াজা, তিন তালাকি (ডিভোর্সের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক নেই, এ তালাক-এর অর্থ নিষিদ্ধ) দরওয়াজা। কেল্লার ভেতরের অংশটা কমবেশি আয়তাকার।


পুরানা কেল্লা গোড়াতে ছিল হুমায়ুনের বানানো শহর দিনপনাহ-র রাজধানী। পনেরোশো তেত্রিশ থেকে শুরু করে পাঁচবছর ধরে তিনি এই কেল্লা বানিয়েছিলেন। কেল্লা বানিয়ে সবে হাঁফ ছাড়ছেন হুমায়ুন, অমনি হইহই করে এসে পড়লেন শেরশাহ সুরি। হুমায়ুন তাড়া খেয়ে একেবারে পারস্যে গিয়ে পৌঁছলেন। শেরশাহ কেল্লার নাম বদলে করে দিলেন শেরগড়। এবং আরও নানারকম ঘরবাড়ি বানালেন। সত্যি কথা বলতে কি হুমায়ুনের ব্রেনচাইল্ড হলেও পুরানা কেল্লায় এখন যে সব স্থাপত্য দেখতে পাওয়া যায় সেগুলো বেশিরভাগই শেরশাহের তৈরি।
যেমন এই মসজিদ। এর নাম কিলা-ই-কুহনা অর্থাৎ পুরোনো কেল্লার মসজিদ। পনেরোশো চল্লিশ বা একচল্লিশ নাগাদ নিজস্ব ব্যবহারের জন্য এই মসজিদ বানিয়েছিলেন শেরশাহ। শোনা যায় লাল সাদা পাথরের সঙ্গে সোনা ও আরও নানারকম দামি পাথর দিয়ে বানানো হয়েছিল এই মসজিদ। মসজিদের ভেতরের হলের ছাদ প্রায় ষাট ফুটেরও বেশি উঁচু। কাজেই ওখানে চেঁচালে বেশ একটা প্রতিধ্বনি হয়। আমাদের ভারতীয়দের মধ্যে আবার সব জিনিস হাতে কলমে পরীক্ষা করার একটা তাগিদ থাকে। দেওয়াল দেখলেই নিজের নাম লিখি, পাঁচিল দেখলেই লাফিয়ে টপকাই, কুয়ো দেখলেই লাফিয়ে নামি আর ফাঁকা উঁচু হলঘর দেখলেই চেঁচাই। চেঁচামেচিতে অস্থির হয়ে আমরা বেরিয়ে এলাম। এদিকওদিক তাকিয়ে মাঠের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা একটা ইন্টারেস্টিং বাড়ি চোখে পড়ল, সেদিকে হাঁটলাম।

কেউ এ বাড়িটাকে হুমায়ুনের লাইব্রেরি বলে, কেউ বলে শের মণ্ডল। চাইলে বাবরের নামেও এটাকে চালানো যায় কারণ বাড়িটার আসল প্ল্যান করেছিলেন তিনিই। যদিও বানিয়ে যেতে পারেননি। তাঁর সেই কাজ শেষ করেন শেরশাহ। শেরশাহ এটা ব্যবহার করতেন "পারসোনাল প্লেজার"-এর জন্য। তারপর পনেরোশো পঞ্চান্ন সালে কেল্লা পুনর্দখল করে হুমায়ুন ফের এটাকে নিজের লাইব্রেরি বানিয়ে ব্যবহার করতে থাকেন। মাত্র বছরখানেক বাদে পনেরোশো ছাপ্পান্ন সালের জানুয়ারি মাসের এক সন্ধ্যেবেলা আজানের ডাক শুনে এই লাইব্রেরি থেকেই তাড়াহুড়ো করে নামতে গিয়ে সিঁড়ি দিয়ে গড়িয়ে পড়ে জখম হন হুমায়ুন। তিনদিন পর তাঁর মৃত্যু হয়।



কেন হয়নি সেটা আশ্চর্য, কিন্তু পুরানা কেল্লা কিন্তু সহজেই হানাবাড়ি বা খুনি কেল্লা বলে পরিচিত হতে পারত। কোনও রাজার কপালেই পুরানা কেল্লার সুখ স্থায়ী হয়নি। হুমায়ুনের কথা তো বললামই. হুমায়ুনকে পুরানা কেল্লা থেকে তাড়িয়ে মোটে পাঁচ বছর বেঁচে ছিলেন শেরশাহ। কিন্তু হুমায়ুন শেরশাহ ছাড়াও পুরানা কেল্লার কোপ যে রাজার ওপর সবথেকে বেশি করে পড়েছিল, তিনি হলেন হেমচন্দ্র ওরফে হেমু।

এই হেমু খুব ইন্টারেস্টিং চরিত্র। পনেরোশো এক সালে তাঁর জন্ম। জন্মের জায়গা নিয়ে মতভেদ থাকলেও সব বিশেষজ্ঞই একমত হয়েছেন যে হিমু জন্মেছিলেন গরিব ঘরে। জীবনের শুরুতে তিনি নুনের ব্যবসা করতেন। ক্রমে দিল্লির ব্যবসাবাণিজ্যের জগতে তাঁর গুরুত্ব বাড়তে থাকে এবং হেমু রাজারাজড়ার চোখে পড়তে শুরু করেন। ব্যবসা ছাড়াও ছোটখাটো যুদ্ধ লড়ার অভিজ্ঞতা ছিল তাঁর। সেটা হেমুর সি ভি-তে কাজে লেগেছিল খুব। পনেরোশো পঁয়তাল্লিশে শেরশাহের মৃত্যুর পর শেরশাহের ছেলে ইসলাম শাহ সিংহাসনে বসলে হেমু তাঁর মুখ্য পরামর্শদাতার স্থান নেন। পনেরোশো তিপান্নতে ইসলাম শাহের মৃত্যুর পর শেরশাহের ভাইপো আদিল শাহ সুরি নামে সিংহাসন দখল করেন। কিন্তু আদিল শাহ ছিলেন পাঁড় মাতাল এবং সর্বার্থেই রাজার অযোগ্য সন্তান। আদিল শাহের আমলে হেমুই হয়ে উঠলেন আসল রাজা। ছোট ছোট আফগান রাজাদের নিজের দলে টেনে নিয়ে তিনি এক ভয়ানক শক্তিশালী সেনাদল বানালেন। কিন্তু এই গোলযোগে মুঘলরা আবার শক্তিশালী হয়ে উঠল। হুমায়ুন পারস্য থেকে ফিরে এসে আদিল শাহ সুরির ভাই সিকন্দর সুরিকে গোহারা হারিয়ে আবার পুরানা কেল্লায় ঢুকে পড়লেন। সেটা পনেরোশো পঞ্চান্ন সাল। হিমু তখন বাংলাদেশের রাজা মহম্মদ শাহের বিদ্রোহ ঠাণ্ডা করতে ব্যস্ত। বিদ্রোহ ঠাণ্ডা হল, মহম্মদ শাহ কোতল হলেন। ঠিক এই সময়েই পুরানা কেল্লার সিঁড়ি থেকে গড়িয়ে পড়ে হুমায়ুন মারা গেলেন। হেমুর কানে খবর গেল। পুরানা কেল্লার তথা দিল্লির সিংহাসন খালি। মুঘল সেনাপতি বৈরম খানের তত্ত্বাবধানে হুমায়ুনের চোদ্দ বছরের ছেলে আকবরের তড়িঘড়ি রাজ্যাভিষেক হয়েছে বটে কিন্ত সে দিল্লিতে নয়, পাঞ্জাবে। হেমুর মনে হল এই সুযোগ। এতদিনের কাজের রাজা হয়ে থেকেছেন তিনি। এবার সুযোগ এসেছে নামেও রাজা হওয়ার। প্রায় পঞ্চাশহাজারের সেনাদল নিয়ে বাংলা থেকে বিহার, উত্তরপ্রদেশ এবং মধ্যপ্রদেশের মধ্য দিয়ে দিল্লির দিকে যাত্রা করলেন হেমু। তাঁর রণোন্মত্ত চেহারা দেখে বেশির ভাগ মুঘল ফৌজদার ঘাঁটি ছেড়ে পালাল। যারা পালাল না তাদের হেমু যুদ্ধে হারিয়ে ঘাঁটি দখল করলেন। আগ্রার মতো গুরুত্বপূর্ণ মুঘল শিবিরও হেমুর কাছে বিনা বাধায় আত্মসমর্পণ করল। পনেরোশো ছাপ্পান্ন সালের ছয়ই অক্টোবর তুঘলকাবাদের সীমায় এসে পৌঁছলেন হেমু। দিল্লির দায়িত্ব তখন তারদি বেগ-এর হাতে। বেগ বিপদ বুঝে বৈরম খানকে খবর দিলেন। বিচক্ষণ বৈরম খান তেরো বছরের আকবরকে তো যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠালেনই না, নিজেও এলেন না। তাঁদের হয়ে যুদ্ধ করতে এলেন বৈরম খানের বিশ্বাসভাজন পির মহম্মদ শরওয়ানি। কিন্তু হেমুকে আটকানো গেল না। মাত্র একদিনের যুদ্ধে মুঘলরা হেমুর কাছে হেরে গিয়ে পালাল। হেমু দিল্লির রাজা হলেন। পুরানা কেল্লায় মহা ঘটা করে তাঁর অভিষেক হল। হেমু নিজের নাম রাখলেন হেমচন্দ্র বিক্রমাদিত্য।



মাত্র একমাস রাজত্ব করতে পেরেছিলেন হেমু। নভেম্বর পড়তে না পড়তে পানিপথের মাঠে বৈরম খান আর আকবরের সেনারা এসে তাঁকে যুদ্ধে আহ্বান করল। দ্বিতীয় পানিপথের যুদ্ধ শুরু হল। এর আগে জীবনে বাইশটি যুদ্ধ লড়েছিলেন হেমু। বাইশটিতেই জিতেছিলেন। কিন্তু এই যুদ্ধে পারলেন না। হাতির ওপর বসে থাকা হেমুর চোখে তীর এসে লাগল। তিনি পড়ে যেতে তাঁর সেনারা ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল। জখম হেমুকে মুঘল সেনারা বন্দী করে নিয়ে গেল বৈরমের কাছে। শুধু রাজ্য কেড়ে নিলেই হত, কিন্তু বৈরম খান হেমুর মাথা কেটে নিলেন। মাথা গেল কাবুলে, দিল্লি দরওয়াজার সামনে সেটাকে ঝুলিয়ে রাখা হল। মাথাহীন ধড়টাকে ঝোলানো হল পুরানা কেল্লার সামনে। মুঘলদের চ্যালেঞ্জ করলে তার পরিণতি কী হয় সেটা সবাইকে বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য।


ব্যাপার হাসির নয় মোটেই, কিন্তু হাসি ছাড়া আর কীই বা করার আছে।


এইসব দেখতে দেখতে পশ্চিমে বড় দরওয়াজার পেছনে সূর্য লাল হয়ে ডুবতে বসল। কেল্লার টিকিট কাউন্টারে তখন লাইট অ্যান্ড সাউন্ড দেখার জন্য লাইন পড়েছে। আমরা বেরিয়ে এলাম, কারণ আমাদের এখন সিটিস অফ স্লিপ দেখতে যেতে হবে। পঁয়ত্রিশতম জন্মদিন উদযাপনের শেষ ইভেন্ট।


*****



আপনারা নিশ্চয় ভাবছেন, উপোসি পেটে এ কেমন জন্মদিন উদযাপন? উপোস আমরা করিনি মোটেই। আমার অফিসের দুজন জন্মদিন পালন করতে ডিগিন'এ গিয়েছিল, এসে খুব সুখ্যাতি করেছিল। সেই থেকে আমার যাওয়ার ইচ্ছে।

ইচ্ছেপূরণ না হওয়ার একটা প্রধান কারণ দোকানটার অবস্থান। ডিগিন আনন্দলোকে গার্গী কলেজের ঠিক উল্টোদিকে। ওই অঞ্চলটা আমাদের কারওরই যাতায়াতের পথে পড়ে না। ছুটির দিনে যাওয়া যায়, কিন্তু ইটালিয়ান খাবার আমাদের দুজনের কারওরই পছন্দের প্রথমদিকে না থাকায় যাচ্ছি যাব করে আর হয়ে উঠছিল না।

আমার বন্ধুরা বলেছিলেন খাবার তো ভালোই, ডিগিন দেখতেও দারুণ। সত্যিই চমৎকার সাজানো দোকান। দোলনায় বাচ্চারা দুলছে, একতলা আর দোতলার বারান্দায় এসে পড়া মিঠে রোদ্দুরে বসে খাচ্ছে লোকজন।



বন্ধুরা যদিও বাইরে বসার সাজেশন দিয়ে রেখেছিল, কিন্তু আমরা জায়গা পেলাম না। তখন বেলা দেড়টা, গমগম করছে ভিড়। মাত্র দুটি চেয়ারওয়ালা একটি টেবিল খালি ছিল, কোনওমতে দৌড়ে গিয়ে সেখানে নিজেদের তশরিফ রাখলাম। এত ভিড় যে পরিবেশকদের মনোযোগ পেতেই গলদঘর্ম। অবশেষে একজন আমাদের ডাকে সাড়া দিলেন। খাবার অর্ডার দিলাম। অটোতে আসতে আসতে হাওয়া লেগে গিয়েছিল বোধহয়, মাথা টিপটিপ করছিল। কাজেই সবার আগে কফি।


ডিগিন'-এর কফি বেশ ভালো লেগেছে আমার। তবে কফির থেকেও ভালো লেগেছে কফির সঙ্গে আসা এই ব্রেড বাস্কেটের ব্যাপারটা। এতে ছিল চারটে ব্রাউন পাউরুটি, দুটো স্টিক বিস্কুট (রাজধানীতে সুপের সঙ্গে যেগুলো দেয়, তবে রাজধানীর বিস্কুটের থেকে রোগাভোগা) আর দুটো গারলিক ব্রেডের নট (গেরো)। এই শেষের আইটেমটাই সবথেকে ভালো খেতে। তুলোর মতো নরম, মেঘের মতো ফুসকো।


মেন কোর্সে আমি নিয়েছিলাম প্রন স্কুইড পিৎজিওলা। পিৎজিওলা হচ্ছে টমেটো, অরিগ্যানো, বাসিল দিয়ে বানানো একরকমের ইটালিয়ান সস। ইটালিয়ান সসের টমেটোর আধিক্যটা আমার পছন্দ নয়, কিন্তু প্রন এবং স্কুইড দুটোই দারুণ প্রিয়। সব মিলিয়ে বেশ ভালোই লাগল খেতে।

প্রন স্কুইড পিৎজিওলার সঙ্গে ফাউ এসেছিল স্যাফ্রন দিয়ে রান্না করা মোটা দানার ভাত আর রোস্টেড গাজর, বিন, ব্রকোলি, জুকিনি। আমি তরকারিগুলো উৎসাহভরে খেতে শুরু করেছিলাম, তারপর যখন দেখলাম যে পিৎজিওলা খেয়েই পেট ভরে যাচ্ছে তখন সবজি ছেড়ে সেই দিকেই মনোনিবেশ করলাম। ভাত ভাতের মতো পড়ে রইল।


অর্চিষ্মান নিয়েছিল ল্যাম্ব শ্যাংক। রেড ওয়াইন সসে ঢাকা নরম তুলতুলে মাংসের সঙ্গে রোস্টেড ভেজিটেবল আর বেবি পটেটো।




জন্মদিনে পেটকে একটু বাড়তি অত্যাচার করার জন্য ডেজার্টে ডিগিন স্পেশাল কফি খাওয়া হল। এসপ্রেসোর মধ্যে এক স্কুপ জেলাতো, চকোলেট সস আর চকোলেট চিপস। এ কফি খেলে ঘুম কাটার বদলে উল্টে পেয়ে যায়। কিন্তু আমাদের তখন ঘুমোলে চলবে না, কেল্লা দেখতে যেতে হবে। কাজেই হাইটাই চেপে অটোতে উঠে পড়লাম। তারপর কী হল সে তো ওপরেই লিখেছি।
*****

এই হল আমার বুড়োবয়সের জন্মদিন উদযাপনের গল্প। আর এই গল্পের সঙ্গে সঙ্গে আমি অবান্তর থেকে সাতদিনের ছুটি নিলাম। গণ্ডার দেখতে যাচ্ছি। ফিরব সেই রবিবার গভীর রাতে। সোমবার একটা পোস্ট ছাপলেও ছাপতে পারি, তবে সেটা ভ্রমণবৃত্তান্ত হবে না, কারণ সে বৃত্তান্ত লিখতে (তার থেকেও বেশি ছবির ব্যবস্থা করতে) ক'দিন সময় লাগবে। ততদিন আপনারা খুব ভালো হয়ে থাকবেন, বড়দিনে বেশ করে মাংকিটুপি পরে কেক খাবেন। টা টা বাই বাই, আবার যেন দেখা পাই।
*****

Diggin
Anand Lok Shopping Centre, Opposite Gargi College, Anand Lok, New Delhi
011 33105376







Comments

  1. Lekhata pore onek gyan orjon korlam :) valo laglo dekhe j jonmodine apni ma er banano sweater ta porechen. Age eita nie ekta post likhechilen. Ajkal office esei ekbar abantor ta khule dekhi notun post er ashay.

    ReplyDelete
    Replies
    1. ধন্যবাদ, ধন্যবাদ, সুহানি। হ্যাঁ, মায়ের সোয়েটারটা আগের বছরেও খুব পরেছিলাম, এবছরেও পরছি। অবান্তরের প্রতি আপনার মনোযোগ স্থায়ী হোক এই প্রার্থনা করি।

      Delete
  2. subho jonmodin.

    bhalo kore, mane onyo kaj kora hoechhe na bole tension na kore, ghure beran. bhalo chobi tulun, amader dekhan ar onake bolun hater angul ba, aro kharap, chaya chara chobi te ar ektu substantially dekha dite..
    oh, happy new year.

    sml (ei tai ebar theke use korbo sei mota lok tar bodole)

    ReplyDelete
    Replies
    1. হাহা, থ্যাংক ইউ থ্যাংক ইউ এস এম এল। আপনার প্রথম শুভেচ্ছাটা মন ভালো করে দিল। সত্যি যদি অপরাধবধ ঝেড়ে ফেলে খারাপলাগা কাজগুলোতে ফাঁকি দিয়ে বুক ঠুকে ভালো লাগা কাজগুলো করার সাহস দেখাতে পারতাম, আমার থেকে খুশি কেউ হত না। দেখি সেই চেষ্টা করব এবার থেকে।

      দ্বিতীয় ইচ্ছেটা অবশ্য আমার হাতে নেই। যার ছবি, তার মত। সে মত অদূর ভবিষ্যতে পালটানোর কোনও লক্ষণ দেখছি না। তবে মানুষের মন তো, যে কোনও দিন পালটাতে পারে, সেটাই ভরসা।

      আপনাকেও শুভ নববর্ষের অনেক শুভেচ্ছা। নববর্ষের দিন আবার জানাব কিন্তু।

      Delete
  3. জন্মদিনের প্রলম্বিত শুভেচ্ছা (আমি শুভেচ্ছা না জানানো পর্যন্ত জন্মদিন শেষ হয় না, তাই বিলম্বিত নয়, প্রলম্বিত)।

    পুরানা কেল্লার পেছন দিকটা এক্সক্যাভেশন করে অনেক পুরনো রাজত্বের এভিডেন্স পাওয়া গেছে, স্তরে স্তরে, মাটির নিচে বিভিন্ন লেয়ারে। যখন এক্সক্যাভেশন চলছিল, আমি গেছিলাম। গত বছরের মার্চ মাস নাগাদ। অনেক ছবি তুলে এনেছিলাম। সে সব আছে আমার ফেসবুকের অ্যালবামে।

    ও হ্যাঁ, খাবারের ব্যাপারে আরেকটা জায়গার সাজেশন দিয়ে রাখলাম - সিরি ফোর্ট পার করে, শাহপুর জাট গ্রামের ভেতরে - দি বিগ বং।

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংক ইউ থ্যাংক ইউ, শমীক। খূব ভালো লাগল শুভেচ্ছা পেয়ে। এক্সক্যাভেশন দেখা নিশ্চয় বেশ থ্রিলিং ব্যাপার? আপনি উৎসাহ করে গিয়েছেন জেনে ভালো লাগল।

      বিগ বং-এ খেয়েছি আমরা। অবশ্য মেন কোর্স নয়। বিকেলের চা, ফিশ ফ্রাই, ডালের বড়া এই সব খেয়েছিলাম। খুবই ভালো লেগেছিল। আবার একদিন যেতে হবে।

      Delete
  4. লেখার ভেতর, ইতিহাসের ছোঁয়া গুলো খুব ভাল লাগল।

    ReplyDelete
  5. Apnake Jonmodiner Subhechha! Ager post-er 'Daam Dharam Kamla Lebu'r byaparta attodine bujhte parlam. "Safal Fruits"! NCR High Five.

    ReplyDelete
    Replies
    1. হাহা, হাই ফাইভ, হাই ফাইভ, রণদীপ। কিনেছ নাকি কমলালেবু? আমরা খুব খাচ্ছি। দারুণ মিষ্টি।

      Delete
  6. বিলেটেড হ্যাপি বার্থডে
    গণ্ডার দেখতে কোথায় চললেন? কাজিরাঙা? গল্পের অপেক্ষায় রইলাম

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংক ইউ, দেবাশিস। ইয়েস, কাজিরাঙ্গা যাচ্ছি। আশেপাশে আরও কিছু জায়গা ঘুরব। শুধু দেহটাই দিল্লিতে পড়ে আছে, বাকি সব গণ্ডারের পিঠে চড়ে বসে আছে বেশ ক'দিন হল। আপনাদের ধরেবেঁধে সে অভিজ্ঞতার গল্প শোনানোর আমারও তর সইছে না।

      Delete
  7. bah tumi kaziranga jaccho? khub bhalo.. amio ghure elam last weekend e tinchuley bole ekta chotto jayga theke.lekhata to nazuk, nazuk. tomar lekhar moto jodi itihaas boi te lekha thakto ami sure madhyamik e ontono 95 peye jetam. seeii sweater ta.. darun lagche.. khub bhalo kore ghure eso.. jobbor lekha chai...

    ReplyDelete
    Replies
    1. বাঃ, কেমন ঘুরলি ঊর্মি? আমরাও এই আজ সন্ধ্যেয় ফিরলাম। দারুণ ঘুরেছি, এইবার লেখা শুরু করব।

      Delete
  8. Jonmodiner onek antorik shubhechha kuntaladi ke..oabantor ebong kuntaladi o kuntaladir priyo jnisgulor jibon sukhi sudirghyo o aro safollomondito hoye uthuk..
    35 tomo jonmodine ekta interesting fact boli..
    Je kono sonkhya kei ulto kore likhle je sonkhya ti paoa jai, sei duto sonkyar ontor 9 er multiple hoy...rabindranth ei byapar ti dekhe khub moja peye likhechhilen.."'noy' 'noy', e modhur khela"

    ReplyDelete
    Replies
    1. হাহা, তাই তো দেখছি হংসরাজ। শুভেচ্ছার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।

      Delete
  9. অন্বেষা সেনগুপ্তDecember 21, 2015 at 6:18 PM

    জন্মদিনের অনেক অনেক শুভেচ্ছা, যদিও মায়ের বানানো সোয়েটার পরে ইশকুলের মেয়ে বলে চালিয়ে দেওয়া যায় :) আমিও দিল্লি যাচ্ছি ২৪-৩০, পুরানা কিলা দেখি নি কোনবারে, এবারে দেখার ইচ্ছে রইল|
    কি বিচ্ছিরি ঠান্ডা পড়ল বলুন দেখি! রাতে তিনটে কম্বল গায়ে দিয়ে হিহিহিহি করি, সকালে বিছানা থেকে উঠতে রীতিমত মনের জোর লাগে :(

    কাজিরাঙ্গা ভ্রমণ খুব ভালো হোক, পোস্ট-এর অপেক্ষায় রইলাম|

    ReplyDelete
    Replies
    1. আরে বা, এখন আপনি তার মানে দিল্লিতে, অন্বেষা। আশা করি ভালো লাগছে।

      Delete
  10. Belated happy birthday Kuntala di. Abar berateo jaccho. tar mane double celebration. Onek moja koro. Onek bhalo thako. Many many happy returns of the day. :)

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংক ইউ, থ্যাংক ইউ, কুহেলি। শুভেচ্ছা পেয়ে খুব ভালো লাগল।

      Delete
  11. satti toke school er meye bole chalano jay . ki mishti lagche :)

    ReplyDelete
    Replies
    1. হাহা, বাজে দেখতে মেয়েদের সবাই ভদ্রতা করে "মিষ্টি" দেখতে বলে, জানিস তো তিন্নি?

      Delete
  12. Amaar onyotomo favourite post eta....ei kichhudin aagei gechilam to purana qila, tai obhigyotagulo relate korte parchhi bhaloi....okhane je shaat-ta rajdhanir dhongshaboshesh achhe jaani, tobe excavation dekha jay jantam na.....

    ReplyDelete
    Replies
    1. আরেবাস, তুমি তো দারুণ ঘুরছ, শ্রমণ। যেদিন ক্যাফে লোটা গিয়েছিলে সেদিনই পুরানা কেল্লা গিয়েছিলে নাকি অন্য আরেকদিন?

      Delete
    2. Na oi Cafe Lota'r din-i gechhilam, amar barir theke ektu dur pore jodiyo, tao gota din-er plan chhoke beriye porechhilam.
      Mone achhe chhotobelay amar boi porar adorsho nayok chhilo Humayun. Je libraryr dorjay mrityuboron korte paare taake sroddha na kore upay ki !
      Shraman

      Delete
    3. হাহা, হুমায়ুন যে কারও নায়ক হতে পারে এটা কেন যেন আমি আগে ভেবেই দেখিনি, শ্রমণ। অবশ্য না হওয়ার কোনও কারণ নেই। বই পড়তে গিয়ে জীবন আর কজনই বা দিয়েছেন, হুমায়ুন ছাড়া? তোমার রোল মডেল নির্বাচনের বিচক্ষণতা দেখে আমি মুগ্ধ।

      Delete
  13. sweater ta full pagla..full..darun kintu..khub sundar.lekhatao sundar.likhecho je kakimar hat e bona sweater.branded fail to..banana sweater er rela e alada..bhalo theko,janmodin er shubechcha,

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংক ইউ, প্রসেনজিৎ।

      Delete
  14. বাড়ি, মামারবাড়ি, শ্বশুরবাড়ি আর একটা বিয়েবাড়িতে ঘোরাঘুরি আর খাওয়াদাওয়ার ঠেলায় কদিন অবান্তরে আসা হয়নি, তাই আপনার জন্মদিনটা মিস করে গেছি। ভেরি ভেরি সরি, আর সেই সঙ্গে জন্মদিনের অনকে অনেক বিলেটেড শুভেচ্ছা। লেখাটাও দারুন হয়েছে। খাওয়ার বর্ণনা তো আপনি ভালই লেখেন, ইতিহাসের অংশটাও খুব ভালো লাগল। আপনাকেও খুব সুন্দর দেখাচ্ছে।

    ReplyDelete
    Replies
    1. দারুণ ঘুরছেন তো, সুগত। খুব হিংসে করলাম। জন্মদিনের শুভেচ্ছার জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ।

      Delete
  15. Ektu deri hoye gelo. Belated Happy b'day Kuntala. Din ti je koto bhalo keteche sheta post porey janlam. Tomar trip o shundor houk. Assam er goppo shonar jonne wait kore roilam.

    ReplyDelete
    Replies
    1. আরে দেরি কীসের শর্মিলা। শুভেচ্ছার জন্য অনেক ধন্যবাদ। থ্যাংক ইউ।

      Delete
  16. Belated Happy Birthday Kuntala !!!! khub khub bhalo theko. biebari ar tar songe free te paoa ghoraghuri sarte gie deri hoe gelo. janmodiner ghoraghuri r chhobi darun .

    ReplyDelete
    Replies
    1. একে বিয়েবাড়ি তায় বেড়ানো? নাঃ, মনটা খারাপ করে দিলেন, ইচ্ছাডানা। আপনার শুভেচ্ছা পেয়ে খুব খুব ভালো লাগল। থ্যাংক ইউ।

      Delete
  17. Jomjomat jonmodin.. anek shubhechha.
    Bratati.

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংক ইউ, থ্যাংক ইউ, ব্রততী।

      Delete

Post a Comment