এ মাসের বই/ ফেব্রুয়ারি ২০১৬



একটা বই সম্পর্কে লেখার আদর্শ সময় কোনটা? যখন সেটা সবে পড়ে উঠেছি, বইটার প্রতি আমার ভালোবাসা, মুগ্ধতা, রাগ, ঘৃণা, বিরক্তি সব একেবারে এই মুহূর্তে আমার জানালার বাইরে রোদ্দুরটার মতো ঝকঝকে, তখন? নাকি বইটা শেষ করার বেশ কিছুদিন পর, যখন আমার চট-প্রতিক্রিয়াগুলো থিতিয়ে পড়ে, ধারালো খোঁজখাঁজগুলো ভোঁতা হয়ে গিয়ে বেশ একটা ঝাপসা কিন্তু নিটোল ছবি মনের মধ্যে ফুটে উঠেছে, তখন?

বইয়ের প্রতি সুবিচারের জন্য হয়তো দ্বিতীয় সময়টা ভালো, কিন্তু অবান্তরের পোস্ট লেখার জন্য একেবারেই নয়। কারণ তাহলে আমাকে স্রেফ ভালো লেগেছিল, খারাপ লেগেছিল, কেঁদে ফেলেছিলাম, হো হো করে হেসে উঠেছিলাম, এইটুকু বলেই ক্ষান্ত দিতে হবে। যেটা আমি একেবারেই চাই না। আমি চাই বইগুলোকে কেটেছিঁড়ে, সেগুলো থেকে বড় বড় কোটেশন দিয়ে তাদের কথা আপনাদের কাছে ব্যাখ্যান করে বলতে।  

পরে লিখব বলে ফেলে রাখলে আরও একটা সমস্যা হয়, সেটা হচ্ছে লেখার তাগিদটা চলে যাওয়া। যে কারণে ফেব্রুয়ারির শুরুতে বেশ কয়েকটা চমৎকার বই (হেমিংওয়ের প্যারিসবাসের স্মৃতিকথা A Movable Feast, তারপর Llosa-র Letter to A Young Novelist, চন্দ্রিলের হাহাহিহি ও অন্যান্য, অবন ঠাকুরের খাতাঞ্চির খাতা) পড়ে ফেলা সত্ত্বেও তাদের নিয়ে এই মুহূর্তে আমার কিছুই বলার নেই। এই রকম একটা কিছু যে ঘটতে পারে সেটা আঁচ করে মাসের মাঝামাঝি থেকে পড়তে শুরু করা বইগুলোর ক্ষেত্রে এ ভুল আমি আর করিনি। তাদের কথাই রইল এই পোস্টে।


Einstein’s Dream/ Alan Lightman


Tiny sounds from the city drift through the room. A milk bottle clinks on a stone. An awning is cranked in a shop on Marktgasse. A vegetable cart moves slowly through a street. A man and woman talk in hushed tones in an apartment nearby. In the dim light that seeps through the room, the desks appear shadowy and soft, like large sleeping animals. Except for the young man’s desk, which is cluttered with half-opened books, the twelve oak desks are all neatly covered with documents, left from the previous day. Upon arriving in two hours, each clerk will know precisely where to begin. But at this moment, in this dim light, the documents on the desks are no more visible than the clock in the corner or the secretary’s stool near the door. All that can be seen at this moment are the shadowy shapes of the desks and the hunched form of the young man.

Ten minutes past six, by the invisible clock on the wall. Minute by minute, new objects gain form. Here, a brass wastebasket appears. There, a calendar on a wall. Here, a family photograph, a box of paper clips, an inkwell, a pen. There, a typewriter, a jacket folded on a chair. In time, the ubiquitous bookshelves emerge from the night mist that hangs on the walls. The bookshelves hold notebooks of patents. One patent concerns a new drilling gear with teeth curved in a pattern to minimize friction. Another proposes an electrical transformer that holds constant voltage when the power supply varies. Another describes a typewriter with a low-velocity typebar that eliminates noise. It is a room full of practical ideas.

ওই যে হাঞ্চড ইয়ং ম্যান, উনিই হচ্ছেন অ্যালবার্ট আইনস্টাইন। আর এই প্র্যাকটিক্যাল আইডিয়ায় ভরপুর ঘরটা ওঁর অফিস। এই কাকভোরে উনি অফিসে এসেছেন কেন? কেন সকালে উঠে গড়িমসি করে চা খেয়ে, যতখানি পারা যায় টিভির সামনে বসে থেকে শেষমুহূর্তে হাঁপাতে হাঁপাতে ওলা অটো ধরেননি? কারণ উনি আইনস্টাইন। আমার অফিস যাওয়া আর ওঁর অফিস যাওয়ার মধ্যে তফাৎ আছে অ্যাকচুয়ালি আইনস্টাইন আরও অনেক আগেই অফিসে আসতে পারতেন। কারণ তাঁর ঘুম ভেঙে গিয়েছিল মাঝরাতেই। স্ত্রীর পাশ থেকে উঠে গিয়ে পা টিপে টিপে রান্নাঘরের আলো জ্বালিয়ে অংক কষছিলেন, ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতে অফিসে এসে গেছেন, আরও অংক কষবেন বলে।

কিন্তু ঘুমটা ভাঙল কেন? একটা স্বপ্ন দেখে। ইদানীং ব্যাপারটা প্রায়ই ঘটছে। গতরাতে, তার আগের রাতে, তার আগের রাতেও স্বপ্ন দেখে আইনস্টাইনের ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। কীসের স্বপ্ন? সেই জিনিসের, যার কথা সারাদিন ভেবে ভেবে আজকাল আইনস্টাইনের মাথা খারাপ হওয়ার জোগাড় হয়েছে। সময়। আইনস্টাইনের রোখ চেপেছে সময়কে তিনি আগাপাশতলা চিনবেন। তার সমস্ত সিক্রেট উন্মোচন করবেন। প্রিয় বন্ধু সুইস ইঞ্জিনিয়ার মিশেল বেসোর সঙ্গে বিকেলে হাঁটতে হাঁটতে, মাছ ধরতে গিয়ে সে কথা বলেওছেন তিনি। কিন্তু সেটুকুই। রাতে ঘুমোতে না দেওয়া স্বপ্নগুলোর কথা বলে উঠতে পারেননি।

আইনস্টাইনের সেই সব স্বপ্ন নিয়ে বই লিখেছেন অ্যালান লাইটম্যান। লাইটম্যান আইনস্টাইনের স্বপ্নের কথা জানলেন কী করে? উনিশশো পঞ্চান্ন সালে আইনস্টাইন যখন মারা গেলেন তখন লাইটম্যান তো সাত বছরের বালক? উত্তর হচ্ছে লাইটম্যান জানেন না। তিনি কল্পনা করেছেন। আইনস্টাইন'স ড্রিমস একটি আদ্যোপান্ত কাল্পনিক কাহিনী। সে কাহিনীতে বাইশ রাতের বাইশটি স্বপ্ন নিয়ে তৈরি হয়েছে বইয়ের বাইশটি চ্যাপ্টার। চোদ্দই এপ্রিল, ষোলই এপ্রিল, ঊনত্রিশে মে, নয়ই জুন ইত্যাদি। অর্থাৎ যে রাতে আইনস্টাইন ওই বিশেষ স্বপ্নটা দেখছেন আইনস্টাইন, সেটাই হল সেই চ্যাপ্টারের নাম।

একেক স্বপ্নে একেকরকম সময় আসে। কোনও কোনও সময় বৃত্তের মতো ঘোরে। কোনও সময় স্রোতের মতো বয়ে যায়, কোথাও পুরোনো হয়ে যাওয়া ঘড়ির মতো থেমে থেমে, হোঁচট খেতে খেতে, থেমে থেমে। আবার কোথাও সময় সরলরেখাও নয়, বৃত্তও নয়, বহুমাত্রিক একেক মুহূর্তে সময় একই সঙ্গে ছেঁড়া সুতোর মুখের মতো ভাগ হয়ে গিয়ে তিনটেচারটে একই বিশ্ব সৃষ্টি করে ফেলেছে, কোথাও কারণের আগেই ঘটে যাচ্ছে কার্য।

তবে সময় কী, সেটা খায় না মাথায় দেয়, সেটা যারা জানে না, তাদের কাছে এই সমস্ত সম্ভাবনার কোনও মানে নেই। কিন্তু সেই সময়ের ফেরে পড়ে মানুষ কেমন ফালাফালা হয়, সেটা জানতে আমাদের ইচ্ছে করে বৈকি। লাইটম্যানের বইয়ের ভালো ব্যাপারটা সেখানেই। এই বিভিন্ন রকম সময় দিয়ে তৈরি বিভিন্ন বিশ্বে আটকে পড়া মানুষের ছবি এঁকেছেন তিনি। কোনও বিশ্বে সময় স্থির, অমরত্ব সেখানে স্বাভাবিক। সে বিশ্বে সব বিচ্ছেদ ফাইন্যাল, সব আলিঙ্গন অনন্ত। তাছাড়াও এই সব সময়েরা আরও ন্যায়নীতি, উচিতঅনুচিত ভালোমন্দের সংজ্ঞা গোলমাল করে দিতে ওস্তাদ। কার্যকারণের পরম্পরা যদি ধ্রুব না হয় তাহলে সে কাজের দায় চাপাব কার ঘাড়ে? বা ওই যে বহুমাত্রিক সময়ের একটা যে কোনও মুহূর্তে আসলে আমি তিনখানা সিদ্ধান্ত একসঙ্গে নিয়ে ফেললাম আর আমার জীবন তিন দিকে ধাইল, তার মধ্যে কোনটা আমার আসল জীবন? কোনটা নকল? কোনটার ওপর আমার মালিকানা অবিসংবাদিত?

সারি সারি স্বপ্নের মাঝে মাঝে দাঁড়িকমার মতো এসেছে প্রোলগ, দুটি ইন্টারলুড, এবং একটি এপিলগ। এই অংশগুলো স্বপ্ন নয়। বাস্তব। বাস্তবের আইনস্টাইন তাঁর বাস্তবের বন্ধু মিশেল বেসোর সঙ্গে বিকেলবেলা হাঁটতে বেরোচ্ছেন, বেসো তাঁকে সস্ত্রীক ডিনারে নেমন্তন্ন করছেন, মাছ ধরতে যাওয়ার প্ল্যান করছেন। আইনস্টাইন তাঁকে নিজের গবেষণার কথা বলছেন বেসো তাঁকে বলছেন,  

“I think you will succeed with your theory of time,” says Besso. “And when you do, we will go fishing and you will explain it to me. When you become famous, you’ll remember that you told me first, here in this boat.”

অ্যালান লাইটম্যান নিজেও সায়েন্সের লোক। তিনি যে সাহিত্যের লোকও হতে পারতেন তার নমুনা শুরুর দুটি অনুচ্ছেদ থেকেই বোঝা যাচ্ছে। ইন ফ্যাক্ট, এম আই টি-তে একই সঙ্গে বিজ্ঞান এবং হিউম্যানিটিস একসঙ্গে পড়ানোর বরাত পেয়েছিলেন তিনিই প্রথম। এই লেখাটা লেখার আগে তাঁর ও তাঁর এই বিশ্ববিখ্যাত বইটির সম্পর্কে ইন্টারনেটে কিছু খোঁজ নিচ্ছিলাম। দেখলাম কেউ কেউ বইটির সায়েন্টিফিক সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। বলছেন লাইটম্যানের দেওয়া সময়ের নমুনাগুলো সব অবাস্তব, অযৌক্তিক, অবিশ্বাস্য। আইনস্টাইন যদি এই বই পড়তেন তাহলে কেঁদেকেটে সারা হতেন। এই বুদ্ধি নিয়ে লোকটা এম আই টি-র প্রফেসর হল কী করে?

বিজ্ঞানের কষ্টিপাথরে এ বই আমল পাবে কি না তার বিচার করার যোগ্যতা আমার নেই, তবে ভালো লাগার দৌড়ে আমার কাছে আইনস্টাইন’স ড্রিম আমার পড়া অনেক বইকে হারিয়ে দিয়েছে এটুকু আমি বলতে পারি।

The man in the queue/Josephine Tey
A Shilling for Candles/ Josephine Tey


জোসেফাইন টে-র আসল নাম এলিজাবেথ ম্যাকিনটশ। আমার পড়া টে-র প্রথম বই দ্য ডটার অফ টাইম। ব্রিটিশ ক্রাইম রাইটার্স' অ্যাসোসিয়েশনের মত অনুযায়ী যে বইটা পৃথিবীর সর্বকালের সেরা রহস্য উপন্যাস। বইটা আমারও দারুণ ভালো লেগেছিল। তা সত্ত্বেও টে-র আর একটিও বই আমি পড়ে উঠতে পারিনি সেটা একটা রহস্য।

পারিনি কি? মাসের মাঝামাঝি টে-র প্রথম বইটা, দ্য ম্যান ইন দ্য কিউ, পড়তে গিয়ে মনে হল, আগে বোধহয় পড়েছি। দ্বিতীয়টা, আ ক্যান্ডল ফর শিলিং, পড়তে গিয়ে নিশ্চিত হলাম আগে পড়েছি। কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে দুটোর একটা বইয়েরও কে খুন করেছে কীভাবে খুন করেছে সে সব কিছুই আমার মনে ছিল না। কাজেই প্রথমবার পড়ছি ধরে নিয়েই পড়া চালিয়ে গেলাম।

দুটো গল্পের প্লট আগে বলে নিই। প্রথম বইটার নাম শুনেই বুঝতে পারছেন, গল্পে একটা লাইন আছে, লাইনে দাঁড়ানো একটা লোক আছে। লাইন লেগেছে লন্ডনের উফিংটন থিয়েটারের সামনে। রে মার্কেবল নামের প্রতিভাময়ী মিউজিক্যাল অভিনেত্রীর হিট নাটক "ডিডন’ট ইউ নো?"র লন্ডনে সেদিনই শেষ শো। ভিড় একেবারে ফেটে পড়ছে। একঘণ্টা, দুঘণ্টা, তিনঘণ্টাও অক্লেশে লোক দাঁড়িয়ে আছে। কেউ কেউ ফোল্ডিং চেয়ার নিয়ে এসেছে। অবশেষে একজন মোটা মতো মহিলা যখন দরজায় পৌঁছলেন, মোটা মহিলাদের যেমন হয়, ব্যাগ থেকে টিকিট বার করতে একঘণ্টা...পেছনের ভিড় অধৈর্য হয়ে উঠেছে... মহিলা ব্যাগের ভেতর জঞ্জাল ঘাঁটছেন... ঠেলাঠেলিতে পেছনের লোকটি তাঁর বিপুল পিঠের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। মহিলা সবে পেছন ফিরে দু’কথা শোনাতে যাবেন, এমন সময় দেখা গেল লোকটার পিঠ থেকে বেরিয়ে রয়েছে একটা চকচকে ছোরা।

টে-র দু'নম্বর বইয়ের নাম আ শিলিং ফর ক্যান্ডল। সকালবেলা ব্রেকফাস্টের জন্য খিদে চাগাতে হাঁটতে বেরিয়ে সমুদ্রতটে একটি মৃতদেহ আবিষ্কার করলেন এক ভদ্রলোক। জানা গেল মৃতদেহটি পৃথিবীবিখ্যাত অভিনেত্রী ক্রিস্টিনা ক্লে-র। কোথাও কোনও ক্লু নেই, কেবল ক্লে-র একঢাল সোনালি চুলে আটকে আছে একটি কোটের বোতাম। তদন্ত শুরু হল। মোটিভের খোঁজে প্রথমেই ডাক পড়ল ক্লে-র উকিলের। আশ্চর্যের ওপর আশ্চর্য। ক্রিস্টিনা ক্লে তাঁর অসীম ঐশ্বর্যের কিছু অংশ দিয়ে গেছেন অচেনা, আধচেনা লোকদের। আর সিংহভাগ রেখে গেছেন ইংল্যান্ডের সৌন্দর্যবৃদ্ধির জন্য। আর নিজের রক্তের ভাইকে দিয়ে গেছেন একটিমাত্র শিলিং। ফর ক্যান্ডলস।

জোসেফাইন টে-র গোয়েন্দার হলেন সি আই ডি ইন্সপেক্টর অ্যালান গ্রান্ট। চেহারা, হাবভাব কোনওদিক থেকে দেখেই তাঁকে পুলিশ মনে হয় না। মনে হয় বড়লোক বাড়ির মেধাবী ছেলে।

দুটো গল্পেরই ভালো লাগা ব্যাপারটা আগে বলি। স্বর্ণযুগের অধিকাংশ গল্পের মতোই জোসেফাইন টে-র গল্প শুরু হয় ক্রাইম দিয়ে। ওয়ার্ল্ড বিল্ডিং, সিন সেটিং, ক্যারেকটার ডেভেলপমেন্ট ইত্যাদি সবই আসে নিজস্ব সময়ে, তদন্ত চলাকালীন, কথোপকথনের মাধ্যমে। টে-র ভাষাও সুন্দর। বর্ণনা, কাব্য সবই আছে, কিন্তু কোথাও তা রহস্যের গতি ব্যাহত করেনি।

দুটো গল্পেরই যে বিষয়টা আমার একটু কমজোরি মনে হয়েছে সেটা হচ্ছে সমাধান। সারা গল্প জুড়ে অক্লান্ত পরিশ্রম করা সত্ত্বেও সমাধানের কৃতিত্ব যেন পুরোটা গ্রান্টকে দেওয়া যায় না, দুই ক্ষেত্রেই তা শিকে ছেঁড়া দইয়ের মতো তাঁর কোলে এসে পড়ে। জোসেফাইন টে-র বাকি গল্পগুলোতেও এরকম হয় কি না দেখার কৌতূহল হচ্ছে।              


The Haunting of the Hill House/ Shirley Jackson

ক্টর মন্টেগু পি এইচ ডি করেছিলেন নৃতত্ত্ববিদ্যায়। সেই থেকে সই করার সময় নামের আগে তিনি ডঃ লেখেন, হ্যান্ডশেক করে নিজের নাম বলার সময় ডক্টর শব্দটার ওপর জোর দেন। কিন্তু ডাক্তার মন্টেগুকে হামবাগ বলে উড়িয়ে দিলে ভুল হবে। এটা তাঁর যত না দর্প, তার থেকে বেশি বর্ম। নৃতত্ত্ব নিয়ে ডিগ্রি থাকলেও তিনি আসলে যে বিষয়টা নিয়ে গবেষণা করেন সেটা এতই অবৈজ্ঞানিক, প্রথাগত শিক্ষাদীক্ষার এতখানিই বাইরের ব্যাপার যে সেটা জানতে পাড়লে প্রতিক্রিয়া হিসেবে যে তাচ্ছিল্য তাঁর প্রতি নিশ্চিত ভাবে ধেয়ে আসবে, তার থেকে খানিকটা আড়াল করার জন্যই ওই ডক্টর শব্দটার আড়ালের প্রয়োজন পড়ে তাঁর।
ডক্টর মন্টেগু কী করেন? ভূত বা বলা উচিত ভূতের বাড়ি খুঁজে বেড়ান। He had been looking for an honestly haunted house all his life. অনেকটা আমাদের অনাথবাবুর মতো। কিন্তু অনাথবাবুর সঙ্গে মন্টেগুর মিল ওখানেই শুরু আর ওখানেই শেষ। অনাথবাবু হয়তো শুধু নিজের পঞ্চেন্দ্রিয় দিয়ে ভূতকে অনুভব করতে পারলেই তৃপ্ত হতেন, কিন্তু ডক্টর মন্টেগু সে ভৌতিকতাকে মাপতে চান। তার উচ্চতা উষ্ণতা সব পুঙ্খানুপুংখ টুকে নিয়ে জার্নালে ছাপিয়ে অবিশ্বাসীদের মুখে ঠুলি পরানোই তাঁর উদ্দেশ্য।

খুঁজতে খুঁজতে অবশেষে একটা বাড়ির সন্ধান মেলে Hill House, not sane, stood by itself against its hills, holding darkness within; it had stood so for eighty years and might stand for eighty more. Within, walls continued upright, bricks met neatly, floors were firm, and doors were sensibly shut; silence lay steadily against the wood and stone of Hill House, and whatever walked there, walked alone. ক্রমশ আমরা হিল হাউসের সম্পর্কে আরও নানা তথ্য জানতে পারি। Every door in this house swings shut when you let go of it. আমরা জানতে পারি হিল হাউসের “insistent hospitality”-র কথা। The last person who tried to leave hill house in darkness - it was eighteen years ago, I grant you - was killed at the turn in the driveway, where the horse bolted and crushed him against the big tree.”

হিল হাউস-এর সন্ধান পাওয়ার পর, এবং চারিদিক থেকে তার ‘হন্টেডনেস’ সম্পর্কে যথেচ্ছ শংসা পাওয়ার পর ডক্টর মন্টেগু সহকারী খুঁজতে বেরোন। সহকারীদের প্রয়োজনীয় যোগ্যতা একটাই, অলৌকিক ব্যাপারস্যাপারের সঙ্গে পূর্বপরিচয়। দলিলদস্তাবেজ ঘেঁটে সে রকম বেশ কয়েকটি নাম জোগাড় করেন তিনি। শেষমেশ মাত্র দু’জন তাঁর ডাকে সাড়া দেয়। একজন এলেনর ভ্যান্স। আরেকজন থিওডোরা। এ ছাড়াও ডাক্তারের টিমে যোগ দেয় লুক স্যান্ডারসন। লুকের সিভি তে অবশ্য ভূতের সঙ্গে গা ঘেঁষাঘেঁষির কোনও প্রমাণ নেই, সে যোগ দিয়েছে হিল হাউসের বর্তমান মালিক স্যান্ডারসন পরিবারের প্রতিনিধি হিসেবে।

গল্পের মুখ্য চরিত্র এলেনর ভ্যান্স। মূলত তার জবানিতেই আমরা হিল হাউসের গবেষণাদলের এই নির্বাচন প্রক্রিয়া, দলের হিল হাউসে এসে পৌঁছনো এবং তারপরের ঘটনাবলী জানতে পারি। সে ঘটনা বলাই বাহুল্য আমি আপনাদের বলছি না, ইচ্ছে হলে নিজেরা পড়ে নেবেন।

এই বইটা আমি পড়লাম যত না বইটার জন্য তার থেকেও বেশি লেখকের জন্য। শার্লি জ্যাকসন বিংশ শতাব্দীর একজন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হরর এবং সাসপেন্স লেখক। জ্যাকসনের একটিও লেখা আমি পড়িনি। তিনি সবথেকে বিখ্যাত তাঁর ছোটবল্প দ্য লটারি-র জন্য। আর তার পরেই দ্য হন্টিং অফ দ্য হিল হাউস। উনিশশো ঊনষাট সালে প্রকাশের পর পরের বছরই অ্যামেরিকার ন্যাশনাল বুক অ্যাওয়ার্ডের জন্য ফিকশন বিভাগে মনোনীত হয়। সে বছর সেই বিভাগের অন্যন্য মনোনয়নের মধ্যে ছিল সল বেলো-র হেন্ডারসন দ্য রেইন কিং, উইলিয়াম ফকনারের দ্য ম্যানশন, জন আপডাইকের দ্য পুওরহাউস ফেয়ার, ওয়ারেন মিলারের দ্য কুল ওয়ার্ল্ড। জঁরা সাহিত্যের একটি বইয়ের এই লিস্টে জায়গা পাওয়া তখন অবিশ্বাস্য ছিল।

শার্লি জ্যাকসনের লেখা সম্পর্কে মন্তব্য করতে গেলে তাঁর আরও অনেক বই পড়া জরুরি, তবে এই বইটা পড়ে আমার যা মনে হল সেটাই বলছি জরাঁ সাহিত্য প্রধানত প্লটনির্ভর হয়। শার্লির গল্পে প্লট একটা থাকলেও প্লটের থেকে অনেক বেশি প্রকট হয়ে ওঠে তাঁর সেটিং। হিল হাউসের প্রত্যেকটি দরজা বন্ধ হয়ে যাওয়ার নৈঃশব্দ যেন আমরা নিজে অনুভব করি, তার বারান্দায় এসে পড়া শীতল রোদ্দুরে আমাদের রোমকূপ যেন এলেনরের রোমকূপের মতোই শঙ্কিত হয়ে ওঠে। সাধারণত এই ব্যাপারটা করতে গেলে অতিকথনের ঝুঁকি থাকে। কিন্তু শার্লি সে ফাঁদে পা দেন না। হিল হাউসের বর্ণনায় ঠিক ততগুলোই শব্দ খরচ করেন তিনি, যতটুকু না হলে নয়। ইন ফ্যাক্ট, যত না বলেন, তার থেকে বেশি না বলা রেখে দেনযে কথাগুলো বলেন না, বলাই বাহুল্য, সেইগুলোই বইয়ের পাতা থেকে উঠে এসে আমাদের মাথার ভেতর ঢুকে যায়। কখনও কখনও এই মিনিম্যালিজমটা বেশ কাঠখোট্টা লাগতে পারে। লেখা যদি মিতভাষের মতো ঝাড়াহাত পা হয়, তাহলে সেটাকে ‘লেখা’ বলে মেনে নিতে কোথায় যেন বাধে। শার্লি জ্যাকসনের লেখা পড়ে সেটা হবে না। ভদ্রমহিলা যতটুকু বলেছেন, সেইটুকুতেই সাহিত্যগুণ ভরে দিয়েছেন।

ভূতের গল্প শুধু ভূতের হলেও ভালো, কিন্তু সে গল্পে যদি যদি অন্য কিছুও ফুটে বেরোয়, এবং ভূতের স্বাদগন্ধের সঙ্গে কোনওরকম কম্প্রোমাইজ না করে, তাহলে ব্যাপারটা একটা আলাদা মাত্রা পায়। হন্টিং অফ দ্য হিল হাউস পড়ে আমার মনে হয়েছে যেন রাতে উঠে একা বাথরুমে যাওয়া থেকে আমাকে নিরস্ত করাই লেখকের একমাত্র মতলব নয়, তার থেকেও বেশি কিছু তাঁর বলার আছে। এলেনর ভ্যান্স যখন হিল হাউসের দিকে চলেছে তখন তার যাত্রাপথের বর্ণনা পড়া যাক।

She had never driven far alone before. The notion of dividing her lovely journey into miles and hours was silly; she saw it, bringing her car with precision between the line on the road and the line of trees beside the road, as a passage of moments, each one new, carrying her along with them, taking her down a path of incredible novelty to a new place. The journey itself was her positive action, her destination vague, unimagined, perhaps nonexistent. She meant to savor each turn of her traveling, loving the road and the trees and the houses and the small ugly towns, teasing herself with the notion that she might take it into her head to stop just anywhere and never leave again. She might pull her car to the side of the highway—although that was not allowed, she told herself, she would be punished if she really did—and leave it behind while she wandered off past the trees into the soft, welcoming country beyond. She might wander till she was exhausted, chasing butterflies or following a stream, and then come at nightfall to the hut of some poor woodcutter who would offer her shelter; she might make her home forever in East Barrington or Desmond or the incorporated village of Berk; she might never leave the road at all, but just hurry on and on until the wheels of the car were worn to nothing and she had come to the end of the world.

বইটা কতখানি ভয়ের জানতে চাইছেন? তাহলে বলি, এ জিনিস ‘রিং’ নয়। এখানে ভূতকে কোথাও দেখা যায় না। কিন্তু কারণ ভয় পাওয়া মানে তো শুধু ভূতকে স্বচক্ষে দেখে দাঁতে দাঁত আর হাঁটুতে হাঁটু ঠোকাঠুকি নয়। বইয়ের পাতার ওপর ভেসে থাকা সারি সারি শব্দ আর তাদের ফাঁকে ফাঁকে জমে থাকা একটা অস্বস্তি, একটা ঘোর বুকের মধ্যে স্পষ্ট অনুভব করতে পারাও ভয়। এই দ্বিতীয়রকম ভয়ের প্রতি ভালোবাসা থাকলে শার্লি জ্যাকসনকে ট্রাই করে দেখতে পারেন।  



Comments

  1. Tomar ager post er jonne likhchi je tumi keno blog post likhbe shetar ektai uttor ... tumi eto shundor kore lekho je pore mon bhore jaye. Tai toh tomar posts er jonne cheye boshe thaki.
    Ar ami keno likhbo tai niye ekhono bhebe jacchi. :-)
    Ami Josephine Tey'r lekha kokhono porini. Teen te boi r naam e tuke rakhlam.

    ReplyDelete
    Replies
    1. আরে থ্যাংক ইউ, শর্মিলা।

      অনলাইন গল্পের বই পড়ায় যদি অনীহা না থাকে তাহল জোসেফাইন টে-র প্রায় সব বই এই সাইটটায় পেয়ে যাবে।

      https://ebooks.adelaide.edu.au/t/tey/josephine/

      Delete
    2. অন্বেষা সেনগুপ্তMarch 2, 2016 at 7:16 PM

      আরে থ্যাংক ইউ | অনলাইন পড়তে কোনো আপত্তি নেই :)
      আমি আপাতত 'এ ডেথ ইন টাস্কানি'নামে একটা বই পড়ছি| লেখক মিশেল জিউত্তারি| ইনি ইতালির পুলিশের বড়কর্তা ছিলেন, পরে লেখা শুরু করেন| বইটা সাংঘাতিক উচ্চাঙ্গের বলছি না, তবে গোয়েন্দাগল্প হিসেবে সুখপাঠ্য এবং edge of the seat | ট্রাই করতে পারেন|

      Delete
    3. Oh thank you Kuntala! Eta darun help korbe ... ager moton boi dhore beshikkhon porte parina bole aajkal online ektu aadhtu pori ... tobe oi boi er shugondho miss kori.
      Eyi link ta r jonne onek dhonnobad. :-)

      Delete
  2. Khub sundor hoyechhe pratiTi boiniye lekha-i.

    Ar shurur oi kothagulo.. "একটা বই সম্পর্কে লেখার আদর্শ সময় কোনটা? যখন সেটা সবে পড়ে উঠেছি, বইটার প্রতি আমার ভালোবাসা, মুগ্ধতা, রাগ, ঘৃণা, বিরক্তি সব একেবারে এই মুহূর্তে আমার জানালার বাইরে রোদ্দুরটার মতো ঝকঝকে, তখন? নাকি বইটা শেষ করার বেশ কিছুদিন পর, যখন আমার চট-প্রতিক্রিয়াগুলো থিতিয়ে পড়ে, ধারালো খোঁজখাঁজগুলো ভোঁতা হয়ে গিয়ে বেশ একটা ঝাপসা কিন্তু নিটোল ছবি মনের মধ্যে ফুটে উঠেছে, তখন?"amogh! Porte porte likha shuru korechhen bole onek kichhu dhora porechhe, seta miss kortam nahole :-)

    Einstein’s Dream/ Alan Lightman wishlist e roilo. Eta portei hobe :) Er sathe apnake arekta boier kotha janate ichche korchhe, amar ek didir jonyo ene diyechhilam, amaro porar ichche aachhe, eto chomoTkar sei boi!
    Michael Paterniti-er lekha "Driving Mr. Albert: A Trip Across America with Einstein's Brain".

    Porer maser boigulor jonyo opekkha kore thaklam. Apnar ekta resolution thik moto rakhchhen, aro porun ar likhun amader jonyo :-)

    ReplyDelete
    Replies
    1. ধন্যবাদ, সায়ন। আপনার বলা বইটার খোঁজে থাকব। আপনিও সুযোগ পেলে আইনস্টাইন'স ড্রিমস-টা পড়ে ফেলবেন। ভালোই লাগবে মনে হয়।

      Delete
  3. শার্লি জ্যাকসনের বইটা পড়ার বাম্পার ইচ্ছে হল গুরু। খুঁজে দেখলাম ৮০০ টাকা দাম!! অগত্যা, পরের মাসে। :(

    ReplyDelete
    Replies
    1. আমি এখন যাকে বলে শার্লি জ্যাকসন ডায়েটে আছি, প্রিয়াঙ্কা। পড়ে দেখো, মনে হয় ভালো লাগবে। এই রকম একজন লেখক এত স্বল্পপরিচিত, সেটা সত্যিই একটা রহস্য। ফেমাস হওয়াটা যে গোটাটাই কপালের ব্যাপার, সেটা আবারও প্রমাণ হয়।

      Delete
  4. Einstein's Dreams ta porar list w rakhlam. Opening paragraphs ar tomar bishleshon, dutoi agroho bariye dilo.

    ReplyDelete
    Replies
    1. ওটা আমার বেশ কয়েকবছরের মধ্যে মনে রাখার মতো বইয়ের তালিকায় জায়গা পেয়েছে, কাকলি।

      Delete

Post a Comment