A Table of One's Own



স্টিফেন কিং-এর ‘অন রাইটিং’-এ একটা টেবিলের কথা আছে। লন্ডনের এক ঝাঁ চকচকে হোটেলের একটি প্রকাণ্ড রাজকীয় টেবিল। সিঁড়ির মাথায় কিংবা লবিতে কোথায় যেন সেটা রাখা ছিল। এমন কোথাও যা লোকের চোখে পড়বে। (সবটাই স্মৃতি থেকে লিখছি। উঠে গিয়ে বুককেস থেকে বই পেড়ে আনতে পারি। কিন্তু আড়াইশো পাতার বইয়ে কন্ট্রোল এফ ছাড়া “টেবিল” কে খুঁজবে? কাজেই শহর মানুষ ইত্যাদি বিশেষ্য গোলমাল হয়ে যেতে পারে। কিন্তু মূল ভাবটার হবে না, প্রমিস।)

কিং-এরও চোখ পড়ল। হোটেলের কর্তৃপক্ষ তাঁকে গর্বিত মুখে জানালেন, এই টেবিলটা একজন লেজেন্ডারি লেখকের। হোটেলবাসের এক রাতে কিং-এর ভয়ানক লেখা পেল, উঠে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, কাগজ পেন পাওয়া যাবে? বেয়ারারা দৌড়ে এনে দিল। কিং জিজ্ঞাসা করলেন এই টেবিলে বসে লেখা যাবে? ম্যানেজার দৌড়ে এসে ঘেরাটোপ সরিয়ে জায়গা করে দিল। টেবিলে বসে স্টিফেন কিং ফসফস করে লিখে ফেললেন ষোলো পাতা। লং হ্যান্ড। এমনিতে কিন্তু কিং লং হ্যান্ড লেখেন না। আমি জানি, ওঁর লেখা নিয়ে আরেকটা লেখায় আমি পড়েছি। কিং লং হ্যান্ড লিখতে পছন্দ করেন, কিন্তু মাথা যে বেগে চলে, পেন সে বেগে চলে না, সে এক ভজঘট ব্যাপার হয়। মাথার সঙ্গে পাল্লা দিতে কি-বোর্ড বেটার।

অ্যাটোনমেন্ট-এর লেখক ইয়ান ম্যাকুয়ান-এর বলছিলেন একবার, লেখার জন্য একটা টেবিল বানিয়েছেন তিনি নিজের জন্য। প্রায় বারো ফুট লম্বা। মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্ত বইয়ে ঠাসা ঘরে, বিরাট বিরাট জানালার সামনে সে টেবিল রাখা থাকে। টেবিলে থাকে শুধু একটি বৃহৎস্ক্রিন অ্যাপেল কম্পিউটার। বাকি জায়গায় বই, খাতা, নোটস। রোজ সকাল সাড়ে ন’টা নাগাদ ফোন, ইন্টারনেট, ইমেল বন্ধ করে এই টেবিলে এসে বসেন ম্যাকুয়ান। আইডিয়া থাক না থাক, লেখার ইচ্ছে থাক না থাক। তারপর টেবিল বুঝবে সে লেখককে দিয়ে লিখিয়ে নেবে কি না।

টেবিলের মহিমায় আমিও বিশ্বাস করি। অফিসে আমার যেটুকু কাজ হয়, আমার টেবিলের কল্যাণেই হয় বলে আমার বিশ্বাস। কত লোককে দেখি ঝটাক ঝটাক টেবিল বদল করছে, ভালো থেকে আরও ভালো, পছন্দসই থেকে আরও পছন্দসই। আমাকে বলে, অনেকদিন তো হল এই ডেস্ক, বদলাতে চাও না? আমি বলি, ভালোই তো আছে। প্রথম যখন এসেছিলাম, কী দুঃখই না হয়েছিল। সবক’টা খুঁত চোখে বাণের মতো বিঁধেছিল। ড্রয়ার আছে, কিন্তু একটু জোরে না ঠেললে পুরোটা বন্ধ হয় না। সামনের বোর্ডে কে সেলোটেপ দিয়ে কী বাণী সেঁটেছিল, টেনে তুলে নিয়ে যাওয়ার সময় ডেস্কের লাল রঙের খানিকটা সঙ্গে করে নিয়ে গেছে। প্রথম ক’মাস যতবার চেয়ারে বসতাম, ওই চটারং চোখে পড়ত। এখন আর পড়ে না। এখন চোখে পড়ে আমার শখ করে কেনা বাহারি জলের বোতল, আমার বাড়ির ডাবর হানির বোতল বেয়ে ওঠা মানি প্ল্যান্ট, চটা রং বোর্ডে সারা বছরের ছুটির হিসেব, আর তার পাশে আমার নিজস্ব পছন্দের বাণী। 

ডান ইজ বেটার দ্যান পারফেক্ট।

*****

আমাদের বাড়িতেও আছে একখানা টেবিল। টেবিলের ওপর খবরের কাগজ, খবরের কাগজের বিল, গল্পের বই, গ্যাসের রসিদ, ওষুধের পাতা, ব্যাংকের পাসবই, খুচরো। বাল্মীকিপ্রতিভার মেক আপ নেওয়া রবীন্দ্রনাথের ছবির নিচে ওঁরই হাতের লেখায় “চিত্ত যেথা ভয়শূন্য…” ছাপা পিচবোর্ড। দু'খানা (কখনও কখনও তিনটে) ল্যাপটপ।গুচ্ছের রিফিলসহ এবং রিফিলছাড়া ডটপেন পেনসিলপোরা ফ্যাবইন্ডিয়ার কাপ, যার মধ্যে নেল কাটার আর ছোট কাঁচিটাও থাকার কথা। ডান হাঁটুর পাশের ওপরের ড্রয়ারে থার্মোমিটার থেকে শুরু করে তেলের বোতলে ছ্যাঁদা করার স্ক্রু ড্রাইভারের মতো দেখতে একটা যন্ত্র, ইউনিভার্সাল অ্যাডাপটর, ব্যাটারির পাতা, আর  অদ্ভুত ভাবে একখানা স্ট্যাম্পের কালি প্যাড। আমার না, অর্চিষ্মানেরও নাকি না।  

ওই টেবিলে বসেই আমি অবান্তর লিখি।  

শুনে মনে হতে পারে আমাকে বেঁধেমেরে লেখানো হয়, তেমন নয়। ওই টেবিলে লেখার অনেকগুলো সুবিধে আছে। অর্চিষ্মান ও ঘরেই থাকে সর্বক্ষণ। এ পাশে আরেকটা ঘর আছে, কিন্তু সেটা দুয়োরানী ঘর। সে ঘরের চেয়ারে আমরা রোজকার পরার জামা ডাঁই করে রাখি। খবর না দিয়ে লোক এলে ভালো ঘরটার আবর্জনা এ ঘরে ছুঁড়ে ফেলে মাঝের পর্দা টেনে দিই। তাছাড়া এ ঘরে টেবিল নেই। লিখতে হলে লিখতে হবে খাটে বসে। আর খাটে বসে লিখতে গেলে একটু পরেই কেতরে শুয়ে পড়ার সম্ভাবনা। টেবিল থেকে নেমে গিয়েও খাটে শুয়ে পড়া যায়, কিন্তু তাতে কয়েকটা স্টেপ বেশি লাগে বলে বিবেক কামড় দেওয়ার সময়ও বেশি পায়। 

তাছাড়াও এ ঘরে লোক থাকে না বলে ঘরটা সবসময় ঠাণ্ডা মেরে থাকে কেমন। কেমন ছায়াছায়া, মনমরা, স্যাতসেঁতে। একদিক থেকে দেখতে গেলে কাজের কাজ করার জন্য এই ঘরটাই আদর্শ। তবু আমার এ ঘরে মন বসে না। 

সাঁইত্রিশ হতে চলল, এখন মন না বসলে আর বসিয়ে কাজ নেই ভেবেচিন্তে আমি এ ঘরের জন্য একটা টেবিলচেয়ারের অর্ডার দিয়েই ফেললাম। শান্তি এসেছিলেন রবিবার সকালবেলা মাপ নিতে। উনি দেওয়ালের গায়ে ফিতে ঠেকাচ্ছেন আর আমি বলছি, “কমান কমান। আরও ছোট করুন। এ টেবিলে থাকবে খালি আমার ল্যাপটপ আর ছোট ডায়রিখানা। ব্যস।” শান্তি বললেন, “ফাইলটাইল? ফোল্ডারটোল্ডার?” আমি বললাম, “কিচ্ছু না, কিচ্ছু না। ইচ্ছে হলেও যাতে না রাখতে পারি এমন করে বানান।” নিচে একখান ড্রয়ার? বিলকুল না। ড্রয়ার এমনিতেই দরকারের বেশি হয়ে গেছে বাড়িতে। শান্তি শেষমেশ বললেন, “একখান জলের বোতল রাখারও জায়গা না হলে কিন্তু প্র্যাকটিকাল হবে না দিদি…” আমি ভেবে দেখলাম জলের বোতল জরুরি, জলের বোতল না হলেও চায়ের কাপ তো রাখতেই হবে। ঠিক আছে, জলের বোতল অ্যালাউ করা যেতে পারে। কিন্তু তার বেশি কিচ্ছুটি নয়। শান্তি মাপ নিয়ে চলে গেলেন। আপাতত উনি গেছেন কলকাতা, মেয়েকে নিয়ে ফিরবেন সামনের সপ্তাহে। আমার ইমপ্র্যাকটিক্যাল টেবিল তৈরি হয়ে চলে আসবে তার পরের সপ্তাহেই।

আমার টেবিল। 

শব্দদুটো সেই থেকে বুকের ভেতর বার বার ধাক্কা মারছে আর একটা অসামান্য ফুর্তি ছেয়ে ফেলছে আমার সারা শরীরমনমাথা। অপরাধবোধ হল। লোকে যে বলে একসন্তানরা স্বার্থপর হয়, কথাটা ভুল নয় তবে। অর্চিষ্মান কানে ইয়ারফোন গুঁজে স্ক্রিনের দিকে হাসিমুখে তাকিয়ে ছিল, গিয়ে একদিকের কান থেকে ফোনটা সরিয়ে বললাম, “তুমি গিয়ে মাঝে মাঝে বোসো ওই টেবিলে, কেমন?” অর্চিষ্মান চোখ ঘুরিয়ে বলল, “বোঝা গেছে।”

*****

যে পোস্টের শুরু কিং-এর টেবিলের গল্প দিয়ে, তাকে কুন্তলার টেবিলের গল্প দিয়ে শেষ করা ভালো দেখায় না। লন্ডনের সেই দামি হোটেলের সংরক্ষিত নক্ষত্রের ছোঁয়া লাগা টেবিলে এক রাত লিখে এমন মোহিত হয়ে গেলেন কিং যে স্থির করলেন তাঁরও ও রকম একখানা টেবিল চাই। সে টেবিলে শুধু কিং লিখবেন। সংসারের আর কোনও কাজে তাকে ময়লা করা হবে না। বাড়ি ফিরেই টেবিলের অর্ডার দেওয়া হল। মহার্ঘ কাঠের, বিস্তীর্ণ টেবিল। যখনতখন লোকে যাতায়াত করে না এমন একখানা ঘর বেছে তাকে স্থাপন করা হল। তার দিকে তাকিয়ে, তার গা থেকে বিচ্ছুরিত মেহগনি আভা দেখে কিং-এর গা ছমছম করতে লাগল। সাহস সঞ্চয় করে টেবিলে বসলেন স্টিফেন কিং। মসৃণ টেবিলটপ তাঁর সামনে ম্যানিকিওরড মাঠের মতো বিস্তৃত হয়ে রইল। কম্পিউটার এল, খাতা এল, বই এল, কি-বোর্ডের ওপর আঙুল উদ্যত হল। লেখা এল না। 

শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত কিং আবার নিজের পুরোনো টেবিলে ফিরে গেছেন, যেটা বাড়ির মাঝখানের একটা ঘরের কোণায় রাখা। এদিকে একটা এক্সট্রা বই গুঁজতে গেলে ওদিকের একটা বই মাটিতে পড়ে যায়। সে ঘরের মধ্য দিয়ে সকলেই চলাচল করে, চেঁচিয়ে একে অপরকে ডাকে। কিং অত্যন্ত বিরক্ত হন, কিন্তু লেখা মহানন্দে স্রোতের মতো বইতে থাকে।

আমারও যদি এরকম হয়? একলা ঘরে একলা টেবিলে বসে লেখার বদলে যদি হাঁ করে দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে টিকটিকির চলাচল দেখতে হয়? সম্ভাবনাটা আমার মাথায় আসেনি তা নয়। সমাধানও এসেছে। যদি ও ঘরে বসে লেখা না বেরোয় তাহলে টেবিলসুদ্ধু আমি আবার এ ঘরে হাজির হব। ওই জন্যই অত ছোট করে বানাতে বলেছি। যাতে আমি আর আমার টেবিল ফিট করে যাই।


Comments

  1. তুমি ছোট টেবিল নিয়ে বারান্দায় ছাদে যেখানে খুশি বোসো , লেখা বন্ধ করা চলবে না ..

    ReplyDelete
    Replies
    1. সে রিস্ক নেই, ঊর্মি। না লিখলে এত সময় নিয়ে ঝামেলায় পড়ে যাব।

      Delete
  2. tomar notun tabiler chhobi diyo

    ReplyDelete
    Replies
    1. আগে আসুক, চুপকথা।

      Delete
  3. "অর্চিষ্মান কানে ইয়ারফোন গুঁজে স্ক্রিনের দিকে হাসিমুখে তাকিয়ে ছিল, গিয়ে একদিকের কান থেকে ফোনটা সরিয়ে বললাম, “তুমি গিয়ে মাঝে মাঝে বোসো ওই টেবিলে, কেমন?” অর্চিষ্মান চোখ ঘুরিয়ে বলল, “বোঝা গেছে।” :P :P
    আর টেবিল এলে ছবি দেবেন প্লিজ, কেমন ?

    ReplyDelete
  4. Je table asar katha howatei sundar lekha ese gechhe, se table ele ni:sondehe aro aro lekha asbe. Table dirghojibi hok.

    ReplyDelete
  5. Ki ashchorjyo! Amrao aj ekta chhoto table chair kine anlam garage sale theke. Sada Rong kora kather desk er samne drawer gulo nil, ar sada chair tar godita matching nil. Kajer kaj kichhu hobe na jonjal jombe Janina, kintu antoto kichhuta jonjal drawer e dhukiye rakha jabe.

    ReplyDelete
    Replies
    1. হ্যাঁ, ড্রয়ার অতি প্রয়োজনীয় বস্তু, সুগত। আপনাদের টেবিল তো সুদর্শন মনে হচ্ছে।

      Delete
  6. Tomar proyojon er besi drawer kemon kore holo boloto? Table asar por amra aro besi lekha pabo asha korchi. Bratati.

    ReplyDelete
    Replies
    1. উল্টোও হতে পারে, ব্রততী। দেখছ তো টেবিলের কথা পাড়া মাত্র প্রায় সাতদিন লেখা বন্ধ। ড্রয়ারের সমস্যাটা হচ্ছে চোখের আড়ালে থাকে বলে কী যে ওতে আছে সেটা মনেই থাকে না। আমি স্থির করেছি এবার থেকে সব চোখের সামনে রাখব।

      Delete
  7. Table ele chhobi chai. Dekhte khubi ichchhe korchhe. Stefen King-er Table-er kothata jene khub bhalolaglo. Oi boita pora nei, wishlist e rakhlam. Apnar ei lekhata chomotkar hoyechhe.. Notun table e onek onek lekha asuk .. emon-i.

    ReplyDelete
    Replies
    1. স্টিফেন কিং-এর লেখা আমার যত না ভালো লাগে, ওঁর লেখা নিয়ে লেখা তার থেকে অনেক বেশি ভালো লাগে। অন রাইটিং আমার পড়া অন্যতম প্রিয় বই। ওটা জোগাড় করে ফেলুন, সায়ন। আপনার ভালো লাগবেই, আমি গ্যারান্টি দিচ্ছি।

      Delete
  8. টেবিল নিয়ে এমন মনোগ্রাহী লেখা কখনো পড়িনি।

    ReplyDelete
    Replies
    1. হাহা, কাকলি। কী যেন বলে ইংরিজিতে, ইউ আর ভেরি কাইন্ড। থ্যাংক ইউ।

      Delete

Post a Comment