পূজাবার্ষিকী আনন্দমেলা ১৪২৪/ শেষ পর্ব




উৎস গুগল ইমেজেস



জিভ থেকে পেট পর্যন্ত দুধ যেন প্রভাতফেরি গাইতে-গাইতে নেমে গেল। 
                                                      —শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, জং বাহাদুর সিংহর নাতি



দ্বিতীয় পর্বের গল্প যে উপন্যাসটা দিয়ে শুরু করব, সেটা আমি পড়েছি বাকি উপন্যাসগুলো পড়ার পর। কারণ আমি জানতাম এই উপন্যাসটাই আমার সবথেকে ভালো লাগবে। লেগেওছে।

জং বাহাদুর সিংহর নাতি/ শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়

শীর্ষেন্দুর উপন্যাসের প্লট নিয়ে নতুন করে লেখার কিছু নেই, কারণ উনি নতুন কিছু লেখেননি। সেই গঞ্জ, সেই বড়বংশের গরিব ছেলে, বিবিধ স্তরের বিবিধ চরিত্র। ডাকাত, ছিঁচকে চোর, ভূত, পুলিশ, প্রোমোটার। এ গল্পে গোলযোগ বেধেছে প্রোমোটার আর বাড়িওয়ালার মধ্যে। বিস্তর গোলযোগের শেষে ঘুমন্ত শক্তির জাগরণ দিয়ে গল্প শেষ।

এই চর্বিতচর্বণের পরেও আমার শীর্ষেন্দুর উপন্যাস সেরা লাগার কারণটাও নতুন কিছু নয়। ১৪২৩-এ এই কারণটাই বলেছিলাম, আমার বিশ্বাস ১৪২৫-এও এই কারণটাই বলব।

শেষমেশ কী লিখেছে-র থেকে কে লিখেছে-টা বেশি ইম্পরট্যান্ট। 

গল্প বলাটা যতখানি আর্ট, তার থেকে অনেক বেশি ক্রাফট। পরিমিত শব্দব্যবহার, সুলিখিত সংলাপ, ঘটনাপরম্পরার স্পষ্টতা, নিখুঁত চরিত্রায়ণ, গল্প বলার সবকটি বিভাগেই শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ক্রাফট বাকিদের থেকে একশো মাইল এগিয়ে। গল্প চেনা এবং খানিকটা ঢিলেবাঁধুনি হওয়া সত্ত্বেও। 

আপ্পু ও পরিদিদি/ রঞ্জন দাশগুপ্ত

ছোটদের গল্প নিয়ে কোথায় একটা পড়েছিলাম, ছোটদের নামে বাজারে চলা অধিকাংশ গল্পই আসলে ছোটদের গল্প নয়। ছোট বয়সের চরিত্রদের কেন্দ্র করে ফাঁদা সে সব গল্পকে আকৃতিপ্রকৃতিতে ছোটদের গল্পের মতো দেখতে লাগে, কিন্তু আসলে সেগুলো বড়দেরই গল্প। আপ্পু ও পরিদিদি পড়ে আমার সেটা মনে হল। 

যেমন ধরা যাক, আপ্পু দেখতেশুনতে আর পাঁচটা বাচ্চা ছেলের মতোই, কিন্তু তার ভাবনাচিন্তায় মাঝে মাঝে বেশ পরিণতি  ঝিলিক দেয়। যেমন ওইটুকু বয়সেই আপ্পূ বুঝে ফেলেছে, “আসলে সব মেয়ের মধ্যেই একটা করে মা লুকিয়ে থাকে।” খুব মন কেমনকরা উদাস গ্রামের ছবি এঁকেছেন রঞ্জন দাশগুপ্ত এই উপন্যাসে। গরু, জঙ্গল, স্কুল, পরি, গাছে চড়া ইত্যাদি মিলিয়ে এই উপন্যাস বেশ নজর কাড়ে, বিশেষ করে বইয়ের বাকি সব উপন্যাসগুলোই যেখানে একটু শহুরে (শীর্ষেন্দু ছাড়া)। গল্পটার প্লট আমি প্রথমটা বিশেষ বুঝতে পারিনি, দ্বিতীয়বার পড়ে নিশ্চিত হলাম প্লট খুব একটা নেই, মোটের ওপর নিষ্পাপ শৈশবের ছবি আঁকাটাই আসল উদ্দেশ্য। ফল্গুর মতো আবার একটা মিষ্টি প্রাপ্তবয়স্ক প্রেমের গল্পও বইছে। শেষ করার পর ওয়ার্ম ফাজি ফিলিং গ্যারান্টিড।


কুমায়ুন রহস্য/ অনীশ মুখোপাধ্যায়

এই উপন্যাসটা কিন্তু আমি লাস্টে পড়িনি। তবু কেন লাস্টে এর রিভিউ লিখছি তার কারণ হচ্ছে আমি কিছুতেই ভেবে উঠতে পারছি না যে গল্পটা সম্পর্কে আমি কী প্রতিক্রিয়া লিখব। আচ্ছা, গল্পটা আগে লিখি, তারপর করে উঠতে পারছি না বাপ্পা হল গোয়েন্দা, নীল হল স্যাটেলাইট। ললিত বলে একটি যুবকের অন্তর্ধান রহস্যের সমাধান করতে তারা উপস্থিত হয় প্রথমে লখনউ, তারপর কুমায়ুনের পাহাড়ে পাহাড়ে। অন্তর্ধান রহস্যের সঙ্গে আবার মন্দিরের গয়নাটয়না চুরির ঝামেলা এসে জোটে, সেই নিয়েই কুমায়ুন রহস্য।

নাঃ, এখনও আমি জানি না কী লিখতে হবে। কুমায়ুন রহস্য আমার দুর্দান্তও লাগেনি, জঘন্যও লাগেনি, কিশোর অ্যাডভেঞ্চার উপন্যাস হিসেবে একবার পড়াই যায় মনে হয়েছে। সেটা কি রিভিউ লেখার জন্য যথেষ্ট? 

এবার ঝট করে ছোটগল্পগুলো নিয়ে বলি।

ছোটগল্পের একটা ভালো ব্যাপার হচ্ছে, বিষয়বস্তুর বৈচিত্র্য। উপন্যাস বড্ড বেশি রহস্য/অ্যাডভেঞ্চারকেন্দ্রিক, আমি নিজে রহস্যপ্রেমিক হয়েই বলছি। 

জাদুকর/ স্মরণজিৎ চক্রবর্তী

চারটি ছোটগল্পের মধ্যে আমার এই গল্পটি ভালো লেগেছে সবথেকে বেশি। স্মরণজিতের ভাষা তো ভালোই, তাছাড়া ওঁর আগের গল্পগুলোতেও দেখেছি খুব সহজ করে একটা গভীর কথা লেখা থাকে। হারুপাগলা আর তোজোর গল্পেও সেরকম আছে। 

নতুন হেডমাস্টারমশাই/প্রচেত গুপ্ত

প্রচেত গুপ্তর গল্পটা ইন্টারেস্টিং একটা কারণে সেটা হচ্ছে এ গল্পে নেগেটিভ চরিত্র প্রায় নেইই। স্কুলের মাস্টারমশাইরা ছেলেপুলেদের অকারণে বা কারণেও ধরে ঠ্যাঙান না, ছেলেরা ভুল করলে নিজেদের খামতি বলে ধরে নেন, আর ছেলেরা যদি মাস্টারমশাইদের নিয়ে ঠাট্টাও করে, যেমন লুকিয়ে নাম দেওয়া, এ সব অত্যন্ত গুড হিউমারে নেন, এবং ঠারেঠোরে সে সব নিরীহ দুষ্টুমিতে উৎসাহও দেন। দুঃখ, বঞ্চনা, জটিলতার মাঝখানে এই গল্পটা বেশ ফুরফুরে হাওয়ার মতো। 

কাচের মুকুট/ ঋতিকা নাথ

ছোটদের মুখোশ পরা বড়দের গল্প বিষয়ে যে কথাটা বললাম, কাচের মুকুট-এর ক্ষেত্রেও সেটা খেটে যায় বলে আমার মনে হয়েছে। এ গল্পের ছোটদের দুষ্টুমিগুলো যেমন বড়দের মতো, ভাষাও তেমনই। ভারি ভারি কথা তারা অনায়াসে বলে ফেলে। তবে সব বাচ্চাদেরই যে শিশুসুলভ গল্প পড়তে ভালো লাগবে তেমন কোনও কথা নেই।কাজেই নানারকম থাকাই ভালো।

হ্যাংলাথেরিয়াম/নবনীতা দত্ত 

নবনীতা দত্তের গল্প আমার সব বছরই ভালো লাগে। ওঁর গল্পের বাচ্চাদের হিংসেহিংসি, সমস্যা, সমাধান, সবই অনেক বেশি  বাচ্চাদের মতো। বুঁচকির যেমন সমস্যা, খাবার দেখলে নিজেকে সামলাতে না পারা। এদিকে পেট খারাপ, এদিকে বন্ধুর জন্মদিনের নেমন্তন্ন। সমাধান কী করে করল বুঁচকি, জানতে হলে পড়তে হবে। 

এছাড়া নন-ফিকশন ছোট ছোট লেখাগুলো যেমন বরাবর হয়, চিত্তাকর্ষক এবং তথ্যসমৃদ্ধ। তবে গল্প কার্টুনের বাইরে আমার বেস্ট লাগে আনন্দমেলার শব্দছক। আমার বাংলা ভোক্যাবুলারির যা ছিরি, তাতে একমাত্র আনন্দমেলার শব্দছকটাই আমি পুরোটা শেষ করতে পারি। তবে পরীক্ষা যতই সোজা হোক না কেন সব উত্তর পারার মধ্যে একটা তৃপ্তি তো থাকেই, সেজন্য আনন্দমেলা শব্দছক সর্বদাই আমার কাছে স্পেশাল।

*****

এবছরের পূজাবার্ষিকী আনন্দমেলার পাঠপ্রতিক্রিয়া শেষ করার আগে দুটো কথা বলব। একটা ভালো, একটা বাজে। বাজেটাই আগে বলি। বইটা ছাপার ভুলে ভরা। এ-কার ও-কার এমনকি বাক্য থেকে গোটা গোটা শব্দ উধাও। এত তাড়াহুড়ো না করে ভালো করে প্রুফ রিড করে পুজোর আরেকটু কাছাকাছি বার করলেও তো হত।

এবার ভালো কথাটা। এমনিতে নতুন বইয়ের গন্ধটন্ধ শোঁকার পালা অনেক দিন ঘুচেছে, নাক বুড়ো হয়েছে বলেই হয়তো, সে গন্ধ পাইনি বহুদিন। ওরকম একটা গন্ধ যে হয় সেটাই ভুলে গিয়েছিলাম বেমালুম। এ বছর আনন্দমেলাটা প্রথম খোলার সঙ্গে সঙ্গে গন্ধটা এল। এখন টাইপ করা থামিয়ে আবার বইটা নাকের কাছে তুলে দেখলাম, এখনও ভুরভুর করছে। প্রায় শিউলি ফুলের গন্ধের মতোই ভালো গন্ধটা, তাই না?


Comments

  1. “আসলে সব মেয়ের মধ্যেই একটা করে মা লুকিয়ে থাকে।” shunei haar pitti jole gelo.

    ReplyDelete
    Replies
    1. কী আর করা যাবে, কুহেলি।

      Delete

Post a Comment